শ্রমিক আন্দোলনে মনির উদ্দিন আহমদের নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে—— চা-শ্রমিক সংঘের শোকসভায় বক্তারা

সিলেট আইন মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ, সর্বজনশ্রদ্ধেয় আইনজীবী, সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রসৈনিক, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, পূর্ব-পাকিস্তান চা-শ্রমিক সংঘের কোষাধ্যক্ষ ও আইন উপদেষ্ঠা প্রবীণ রাজনীতিবিদ এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদের স্মরণে এক শোকসভায় বক্তারা বলেন- চা-শ্রমিক আন্দোলনে প্রয়াত মনির উদ্দিন আহমদ, মফিজ আলীসহ তৎকালীন চা-শ্রমিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেন, এইসব নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত চেষ্ঠায় ১৯৬৪ সালে ৩ মে শমসেরনগরে পূর্ব-পাকিস্তান চা-শ্রমিক সংঘের উদ্যোগে প্রথম মহান মে দিবস পালন করে। সেই সময় মে দিবসে চা-শ্রমিকদের ছুটি ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তান চা-শ্রমিক সংঘের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চা-শ্রমিকরা আজ মে দিবসে ছুটি ভোগ করছেন। সেই প্রতি রবিবার মনির উদ্দিন আহমদ সিলেট থেকে এসে বাগানে বাগানে গিয়ে চা-শ্রমিকদের নিয়ে সভা করতেন। এজন্য অনেক সময় রাত হয়ে গেলে তিনি চা-শ্রমিক সংঘের শসসেরনগরস্থ অফিসে বা কোন বাগানে রাত কাটাতেন। ১৯৬৭ সালে শমসেরনগর চা-বাগানে পুলিশের গুলিতে নীরা বাউরি শহীদ হলে সেই সময় প্রয়াত মনির উদ্দিন আহমদ, মফিজ আলীসহ নেতৃবন্দ তীব্র চা-শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলেন। সভায় বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন চায়ের আবাদ বাড়ছে, বেড়েছে চা-উৎপাদন ও মূল্য দুটোই, মালিকদের মুনাফাও প্রতিবছরই বাড়ছে; শুধু বাড়ছে না শ্রমিকের মজুরি। বিগত মৌসুমেও লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে রেকর্ড দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। তারপরও বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে চা-শ্রমিকদের সর্বোচ্চ মজুরি দৈনিক মাত্র ১০২ টাকা, ৫/৭ জনের একটি চা-শ্রমিক পরিবারে যা দিয়ে একবেলার খাবার জুটানোই দায়। মজুরি চুক্তির মেয়াদ প্রায় ৭ মাস আগে পার হলেও দালাল নেতারা মালিকের স্বার্থ রক্ষায় নিরবতা পালন করছেন। বেঁচে থেকে সুস্থ্যভাবে কর্মক্ষমভাবে উৎপাদনে সক্রিয় থাকতে হলে বর্তমান বাজারদরে একজন চা-শ্রমিকের মূল মজুরি ২০ হাজার টাকা হিসেবে দৈনিক ৬৭০ টাকা মজুরির বিকল্প নেই। এ কথা বললে মালিক পক্ষ ও দালাল নেতৃত্ব শ্রমিকদের উপর চড়াও হয় আর তথাকথিত সুশীল সমাজ ও বামনামধারীরাও ভ্রু কুচকায়। অথচ প্রতিবেশি ভারতে এ বছর ৮ ও ৯ জানুয়ারি ন্যূনতম মূল মজুরি ১৮,০০০ হাজার রুপি (২১,৬০০ টাকা) ঘোষণাসহ ১২ দাবিতে ভারতের সর্বস্তরের শ্রমিকদের দেশব্যাপী ৪৮ ঘন্টার ধর্মঘটে চা-শ্রমিকরা একাতœ হয়ে দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কা, কেনিয়ার চা শ্রমিকরা আমাদের থেকে অনেক বেশি মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। সভায় বক্তারা বলেন- প্রবীণ রাজনীতিবিদ মনির উদ্দিন আহমদ আইন পেশার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লেবার ইউনিয়ন, সিলেট ইলেকট্রিক সাপ্লাই শ্রমিক ইউনিয়ন, আজিজ গ্লাস ফ্যাক্টরি শ্রমিক ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত চা শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে শ্রমিক জননেতা মফিজ আলীর সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ভূমিকা রাখেন এবং পূর্ব-পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ এর কোষাধ্যক্ষ ও আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সৃষ্টির ৪৯ বছর পার হলেও কখনো রাষ্ট্রপতি শাসিত, কখনও সংসদীয় পদ্ধতি, কখনও সেনা সরকার, কখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় শাসিত এদেশের জনগণ শোষণ, লুন্ঠন থেকে মুক্ত হয়নি। তাই আসুন প্রয়াত মনির উদ্দিন আহমদের আজীবন লালিত স্বপ্ন সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ মুক্ত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হই। গত ২১ জুলাই চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির অন্যতম নেতা প্রবীণ চা শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল বেগম্যান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি কবি শহীদ সাগ্নিক, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহবায়ক ডা. অবণী শর্ম্মা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস ও ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা। সভার শুরুতে প্রয়াত রাজনীতিবিদ এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ (৯৬) এর মৃত্যুতে তাঁর অসমাপ্ত কাজকে অগ্রসর করার প্রত্যয়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাড়িয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন – চা-শ্রমিক সংঘের যুগ্ম-আহবায়ক হরিনারায়ন হাজরা, সুনছড়া চা-বাগানের পুষ্প কালিন্দী, রবিন্দ্র রবিদাস, মহিলা চা-শ্রমিক ভানুমতি কর্মকার, চাতলাপুর চা-বাগানের নারায়ন নাইড়–, রাজনগর চা-বাগানের শ্রমিকনেতা নারায়ন গোড়াইত, মধু রজক, হেমরাজ লোহার, লংলা চা-বাগানের সন্যাসী নাইড়–, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি দেলোয়ারা বেগম, মৌলভীবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহীন মিয়া, মৌলভীবাজার জেলা রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল মিয়া, কমলগঞ্জ উপজেলা স’মিল শ্রমিক সংঘের সভাপতি মোঃ ফরিদ মিয়া, শ্রমিকনেতা মোঃ শাহজাহান আলী ও গিয়াস উদ্দিন প্রমূখ।