মসজিদের খতিবের যোগ্যতা ও গুণাবলি

ইমাম ও খতিব হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। ইসলামের প্রথম যুগে সাধারণত খলিফাগণই রাষ্ট্রের প্রধান মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তী সময় থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন দ্বীনদার আলেমগণ এই গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। ইসলামি গবেষকগণ কোরআন ও হাদিসের মূলনীতি অনুসারে যোগ্য খতিবের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। এখানে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

তাকওয়া
মসজিদের খতিব মানুষকে পাপাচারের পথ ছেড়ে পুণ্যের পথে চলার আহ্বান জানাবেন। এখন তিনি নিজেই যদি আমলদার না হন, তাহলে তাঁর আহ্বান তেমন ফলপ্রসূ হবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও, তোমরা যে কিতাব শিক্ষা দাও এবং যা কিছু নিজেরা পড়ো তার ফলশ্রুতিতে।’ (সুরা আল ইমরান: ৭৯) অন্য আয়াতে বে-আমল উপদেশ দানকারীদের তিরস্কার করে বলেন, ‘তোমরা অন্যদের সৎকর্মশীলতার পথ অবলম্বন করতে বলো, কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে যাও। অথচ তোমরা কিতাব পাঠ করে থাকো। তোমরা কি জ্ঞানবুদ্ধি একটুও কাজে লাগাও না?’ (সুরা বাকারা: ৪৪)

ধর্মীয় জ্ঞান
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব সবচেয়ে যে ভালো পড়তে জানে, সে ইমামতি করবে। এ ক্ষেত্রে সবাই সমান হলে সুন্নাহ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি যে জানে সে ইমাম হবে।’ (মুসলিম)

আপসহীনতা
জুমার খুতবা দিতে হয় নির্ভীক ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে, যেন কোরআন-হাদিসের কথাগুলো মানুষের কর্ণকুহর ভেদ করে হৃদয়ে গেঁথে যায়। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) যুদ্ধগামী সৈন্যদলকে সতর্ক করার মতো বলিষ্ঠ কণ্ঠে খুতবা দিতেন। (মুসলিম)

স্পষ্ট ও শুদ্ধ ভাষা
খতিব যিনি হবেন, তিনি মূলত খুতবার মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেবেন। সুতরাং, তাঁর মুখের ভাষা স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ হওয়া আবশ্যক। মুসা (আ.) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার আদেশপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর মুখের জড়তা দূর করে দেওয়ার দোয়া করেন এবং ভাই হারুন (আ.)কে স্পষ্টভাষী হওয়ার কারণে নিজের সহযোগী হিসেবে পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। (সুরা তহা: ২৭; সুরা কাসাস: ৩৪)

নিয়ন্ত্রিত কথা বলা
এক খতিব খুতবার মধ্যে একটা কথাকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যে তা থেকে আল্লাহ ও রাসুলের মর্যাদা সমান হওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ পায়। এটা জানার পর রাসুল (সা.) তার প্রতিবাদ করলেন এবং বললেন, ‘তুমি তো মন্দ খতিব!’ (মুসলিম) রাসুল (সা.) নিজেও খুতবায় নির্দিষ্ট করে কোনো ব্যক্তির নিন্দা করতেন না। বরং কারও কোনো অপরাধ দৃষ্টিগোচর হলে সাধারণভাবে সেই অপরাধের ব্যাপারে কথা বলতেন, নির্দিষ্ট কারও নামোল্লেখ করতেন না। (আবু দাউদ)

নির্লোভ মনোভাব
খতিবের মনে যদি সম্পদ বা অন্য কোনো পার্থিব স্বার্থ অর্জনের লোভ থাকে, তা তাকে সত্য উচ্চারণে বাধা দেবে। এ জন্যই আল্লাহ তাআলার সব নবী-রাসুল নির্লোভ ছিলেন। তাঁরা মানুষের কাছে সত্যের আহ্বান পৌঁছানোর বিনিময় চাইতেন না। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা এমন লোকজনের কথা মেনে নাও, যারা তোমাদের কাছে বিনিময় চায় না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা ইয়াসিন: ২১)

প্রয়োজনীয় সাধারণ জ্ঞান
বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনুসারে মুসলমানদের কখন কী করণীয়—কোরআন ও হাদিসের আলোকে মানুষকে জানানো খতিবের দায়িত্ব। তাই খতিবকে ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখতে হবে এবং বিচার-বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা থাকতে হবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যুদ্ধ, মহামারিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হতো মসজিদের মিম্বার থেকে।

নিরহংকার হওয়া
অহংকার মানুষকে অপ্রিয় করে তোলে। অহংকারী মানুষের কথা কেউ কানে নিতে চায় না। খতিবের মাঝে এই নিকৃষ্ট স্বভাবটি থাকলে তার থেকে জাতি, রাষ্ট্র ও ইসলামের কোনো উপকার আশা করা যায় না। রাসুল সা. সম্পূর্ণ নিরহংকার ছিলেন। কোনো দাসীও যদি তাঁকে কিছু বলতে চাইত, তিনি আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনতেন। কোনো প্রয়োজনে তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি তার সঙ্গে যেতে দ্বিধা করতেন না। (বুখারি) খুতবা দেওয়ার সময় কোনো ছোট বাচ্চা তাঁর দিকে ছুটে গেলে তাকে কোলে তুলে নিতেন। (তিরমিজি)

যুগোপযোগী প্রাণবন্ত আলোচনা
সংবাদ পড়ার মতো একনাগাড়ে বয়ান করে গেলে মুসল্লিদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরক্তি চলে আসে। প্রতি জুমায় একই বিষয়ে কিংবা ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকলেও বয়ানের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই খতিবকে একদিকে যেমন আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বয়ান করতে হবে, তেমনি প্রতি জুমায় প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী বিষয়ের ওপর তাত্ত্বিক আলোচনা করতে হবে। বয়ানে কোরআন ও হাদিস থেকে রেফারেন্স এনে আলোচ্য বিষয়কে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। রাসুল (সা.) ও সাহাবিগণ তা-ই করতেন।

হাদিসশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য
জুমার বয়ানে অনেক খতিব অসত্য ও অপ্রমাণিত কিসসা-কাহিনি বর্ণনা করেন। অসংখ্য জাল ও বানোয়াট হাদিস বলে থাকেন। এই প্রবণতা খুবই জঘন্য। হাদিসে রাসুল (সা.) এই নিকৃষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং অমান্যকারীদের জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন। (বুখারি ও মুসলিম) এ কারণেই গবেষকগণ বলেন, মসজিদের মিম্বারে এমন লোকজনকে বসাতে হবে, যাঁরা হাদিস শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, অর্থাৎ হাদিসের শুদ্ধ-অশুদ্ধ যাচাই করার যোগ্যতা রাখেন।