দান করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো শুধু সামাজিক দায়িত্বই নয়, এটা একজন মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। আর সে-ই প্রকৃত মানুষ, যে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। দান-সদকা, সাহায্য-সহযোগিতা ইসলামের সৌন্দর্য। দান-সদকার মাধ্যমে সমাজে গরিব-ধনী তথা উঁচু-নিচুর ভেতরে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়।

গরিব, অসহায় ও নিঃস্বদের অভাব অনটন লাঘব হয়। তাদের কষ্টের জীবনে কিছুটা হলেও আনন্দ হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে এ ব্যাপারে কোরআন মাজিদে অনেক উৎসাহব্যঞ্জক বাণী এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা করো, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরো বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭১)

নবী করিম (সা.) বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। (বুখারি, হাদিস : ৬০২৩)

মানব সেবামূলক সব কিছু এই ‘দানশীলতা’ শিরোনামের অধীনে। অভাবী মানুষদের জন্য অর্থ খরচ করা, নিজের জ্ঞানগত যোগ্যতা বা পদগত ক্ষমতার মাধ্যমে তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকা। নিজের সুবিধা-অসুবিধা না ভেবে তাদের সেবায় উদার মনে কাজ করতে পারাই হবে বদান্যতা।

স্বয়ং কোরআনুল কারিম বদান্যতাকে একটি মৌলিক নেক কাজ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে সবাইকে। কোরআনুল কারিমের প্রথম দিকে সুরা বাকারার প্রথম রুকুর আয়াতগুলোতে মুমিনের কামিয়াবির মৌলিক গুণাগুণ বলা হয়েছে। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা আমার দেওয়া জীবনোপকরণ থেকে (আমার রাস্তায় অন্যদের ওপর) খরচ করে।’

মুফাসসিররা আয়াতের তাফসিরে বলেন, আল্লাহর দেওয়া বান্দার প্রতি অর্থ-সম্পদ ছাড়াও দৈহিক শক্তি, শিল্পগুণ, কর্মযোগ্যতা ইত্যাদির মাধ্যমেও সৃষ্টিকুলের সেবা করা দানশীলতার অংশবিশেষ।

এ মর্মে আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে রিজিক দান করেছি, তা থেকে তোমরা (আল্লাহর রাস্তায় মানব কল্যাণে) ব্যয় করো সেই দিন আসার আগে, যেদিন কোনো ক্রয়-বিক্রয় থাকবে না, কোনো বন্ধুত্ব কাজে আসবে না এবং সুপারিশও গ্রহণযোগ্য হবে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৪)

অন্য এক আয়াতে দানশীলতার প্রতি উৎসাহিত করতে, এর উপকারিতা ও সওয়াবের গুরুত্ব বোঝাতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যে সম্পদই (মানুষের কল্যাণের জন্য) ব্যয় করবে তা তোমাদের কল্যাণে আসবে। আর তোমাদের অর্থ ব্যয় শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত এবং তোমরা যে সম্পদই ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদের দেওয়া হবে। তোমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭২) আরো এক মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে আল্লাহ তায়ালা দানশীলতাকে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং আল্লাহকে ঋণ দাও, উত্তম ঋণ।’ (সুরা : মুজাম্মিল, আয়াত : ২০)

দানশীলতার ব্যাপারে কোরআনের আরেকটি হিদায়াত হলো, দান-সদকা ও সহযোগিতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার রাজি খুশির নিমিত্তেই হওয়া। লোক-দেখানো, নিজের প্রভাব বিস্তার ও অন্য কোনো মতলবে না হওয়া। বরং মানবসেবার যে কাজই হোক না কেন তা হবে কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের অর্থ ব্যয় কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭২)

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটা জিনিসেরই কিছু নিয়ম-নীতি থাকে আর দান-সদকার ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় কিছু নিয়ম-প্রণালী রয়েছে।

যেমন—

১. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করা। এতে মানুষের প্রশংসা কুড়ানো বা দুনিয়াবি কোনো স্বার্থে জড়িত না থাকা।

২. পবিত্র অর্থ দান করা। কেননা আল্লাহ নিজে পবিত্র। তিনি পবিত্র জিনিস ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না।

৩. নিয়মিত দান করা যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। এটি আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল।

৪. প্রশস্ত মনে, উদার চিত্তে সওয়াবের নিয়তে দান করা।

৫. রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় অভাবীদের দান করার সওয়াব দ্বিগুণ। এতে দান ও আত্মীয়তা রক্ষার সওয়াব পাওয়া যায়।

৬. বেশি অভাবীকে অগ্রাধিকার দেওয়া। (যদিও বিশেষ প্রয়োজন ও জরুরি দরকার হলে এই ধারাবাহিকতা রক্ষা জরুরি নয়।)

৭. গোপনে দান করা। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, গোপনে এমনভাবে দান করতে হবে যে যেন ডান হাত দান করলে বাম হাত জানতে না পারে। এভাবে গোপনে দানকারীকে মহান আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন। তবে কেউ তাকে দান করতে দেখলে উৎসাহিত হবে বা অন্যরাও এগিয়ে আসবে এই নিয়তে প্রকাশ্যে দান করা জায়েজ আছে।

৮. যদি জানা যায়, যাকে দান করা হবে তার হাতে অর্থ গেলে সে তা হারাম ও গুনাহের কাজে ব্যয় করবে, তাহলে তাকে দান করা জায়েজ নেই।

৯. বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য পূরণের নিয়তে মাজার, কবর, মৃত ব্যক্তি বা কোন মন্দিরে দান করা জায়েজ নেই।

১০. দ্বিনি প্রতিষ্ঠানে দান করার ক্ষেত্রে সেসব প্রতিষ্ঠানে দান করা উচিত, যেখানে তাওহিদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক দ্বিনি ইলম শিক্ষা দেওয়া হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে শিরক-বিদআত শেখানে হয় সেগুলোতে দান করা হারাম। কারণ তাতে শিরক-বিদআত চর্চায় সহায়তা করা হয়।

১১. নিজের প্রিয় জিনিস দান করা অধিক সওয়াবের।

১২. পিতামাতা বা অন্যান্য মৃত মুসলিমদের পক্ষ থেকে দান-সদকা করা জায়েজ। এতে তারা কবরে থেকেও সওয়াব লাভ করে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সম্পদ দান করা উত্তম, যা দ্বারা মানুষ দীর্ঘদিন উপকৃত হয়। যেমন—জায়গা-জমি ওয়াকফ করা, মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ, টিউবওয়েলের ব্যবস্থা, দরিদ্র দ্বিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা, পোশাক, বই-পুস্তক ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। এগুলো সব সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

১৩. সারা বছর দান করা যায়। তবে রমজানে বেশি পরিমাণে দান করা সুন্নত। কারণ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) এ মাসে ‘প্রবহমান বাতাস’ এর চেয়ে বেশি দান করতেন।

২৪. সমাজের অভাবী লোকদের খোঁজ নিয়ে তাদের বাড়িতে দানের সামগ্রী গোপনে পৌঁছে দেওয়া উত্তম। কারণ এ ধরনের মানুষ অভাবে কষ্ট পায়; কিন্তু চক্ষুলজ্জায় কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারে না।