নাটোরের মহারাজা স্কুল এন্ড কলেজে জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য

// নাটোর প্রতিনিধি
দেশের অন্যতম প্রাচীন নাটোর মহারাজা জে এন স্কুল এন্ড কলেজ এর প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির সাথে যোগসাজসে অনিয়ম করে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ এবং অবৈধভাবে এমপিও কার্যক্রমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জনবল কাঠামোর বাইরে দুইগুন বেশি জনবল নিয়োগ দিয়ে এমপিও করা, অতিরিক্ত সময়ে কাজের অজুহাতে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে অর্থ উত্তোলনসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়েছেন তিনি। নিজেকে অধ্যক্ষ হিসেবে পরিচয় দিলেও এই প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮১সালে প্রতিষ্ঠিত নাটোর মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০১৫ সালে কলেজ শাখার কার্যক্রম শুরু করা হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পাঠদানের অনুমতি এবং একাডেমিক স্বীকৃতি পাওয়ার পরে কলেজ শাখার ১৮জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও’র প্রত্যাশায় শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন। এসব শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের সময়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আব্দুল মজিদ। ২০২২ সালে কলেজ শাখা এমপিওভূক্ত হলে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম নিয়োগপ্রাপ্ত ১৮জন শিক্ষক-কর্মচারীর তালিকা অবৈধভাবে রদবদল করেন। গণিতের প্রভাষক পদে সাত বছর করে পাঠদানকারী আব্দুল মান্নান এবং ইংরেজীর প্রভাষক ওমর ফারুককে বিদায় করে ৪০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে গণিতের প্রভাষক পদে আশরাফুল ইসলাম এবং ইংরেজীর প্রভাষক পদে সুনাম চন্দ্রকে নিয়োগ দেন। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির জনবল প্রতিবেদনে এই দুই শিক্ষকের নাম রয়েছে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক ২০২০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও ঐ দুই শিক্ষকের নাম আছে। নতুন দুই শিক্ষককে নিয়োগ দানের জন্যে ২০১৫সালের নিয়োগের সকল কাগজপত্রে বেআইনীভাবে ঘষা-মাজা করে নাম পরিবর্তন করা হয়। নিয়োগকালীন প্রধান শিক্ষক আব্দুল মজিদ বলেন, ব্যবস্থাপনা কমিটি সভার নিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে দুইজনের নাম বাদ দিয়ে নতুন দুইজনের নাম সংযোজনের জন্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কলেজ এমপিও’র পূর্বে আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে, আমি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখান করি। একই কথা বলেছেন নিয়োগকালীন সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি এবং তৎকালীন নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক দিলীপ কুমার ভদ্র। কলেজ শাখা এমপিও ঘোষণার পরে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া নেতা ও নাটোর পৌরসভার কাউন্সিলর জাহিদুর রহমান জাহিদকে সাথে নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে কোটি টাকার উপরে উত্তোলন করেন প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রভাষক জানান, ২০১৫ সালে নিয়োগের পরে সাত বছরের অধিক সময় ধরে কলেজে বিনা পয়সায় নিয়মিত শ্রেণী পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। চাকুরীর বয়স চলে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে এই বিপুল পরিমান টাকা দিয়ে চাকুরী রক্ষা করেছি।
বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো নীতিমালা অনুসারে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে নিরাপত্তা কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নৈশ প্রহরী এবং আয়া পদে চারজন ব্যক্তিকে নিয়োগ এবং এমপিও করতে পারবে। কিন্তু এমপিওভূক্ত স্কুলের তথ্য গোপন করে প্রধান শিক্ষক এসব পদে অতিরিক্ত আরো পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়ে মোট ৯জনকে এমপিওভূক্ত করেছেন। এই এমপিও জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত বেতনভাতা খাতে প্রতি মাসে সরকারি অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে। অফিস সহকারী ছাড়াও অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত বেশীরভাগ চতূর্থ শ্রেণীর কর্মচারী প্রধান শিক্ষকের আতœীয়। গত ১ আগষ্ঠ তিনি আরো একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানের ভূক্তভোগী একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী জানান, প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আশরাফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানে ভীতি আর বিভাজনের সংস্কৃতি চালু করেছেন। কথায় কথায় চাকুরিচ্যুতি আর পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার হুমকি, কারন-দর্শাও নোটিশ ইস্যু এবং অপমান-অপদস্ত করা তার প্রতিদিনের স্বভাবসিদ্ধ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রধান শিক্ষকসহ চারজন অতিরিক্ত সময় কলেজের কাজ করার অজুহাতে প্রতিমাসে কয়েক হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক গ্রহন করেন। প্রধান শিক্ষকের ঘন্টাপ্রতি পারিশ্রমিক ১৫০ টাকা, প্রভাষকের ১০০ টাকা এবং অফিস সহকারীর ৭০ টাকা।
সম্প্রতি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হাত করতে অযাচিতভাবে স্কুল-কলেজের সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার এবতেদায়ী শাখা চালু করার ঘোষণা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রমে ভাগ-বাটোয়ারার লোভ দেখিয়েছেন তিনি।
প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম ২০১৭সালে নাটোর মহারাজা জে এন স্কুল এন্ড কলেজে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। নিয়োগের পরে তাঁর বিএড সনদের জালিয়াতি প্রকাশ পেলে তাকে বরখাস্ত করে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জাহিদুর রহমান জাহিদের এ সংক্রান্ত বক্তব্য ভাইরাল হয়েছিল। বিতর্কিত এই ব্যক্তিকে ২০২১ সালে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদানের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক পদে গোপনে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রধান শিক্ষকের পদ শূণ্য ঘোষণার নিয়ম থাকলেও ঐ পদ শূণ্য ঘোষণার আগেই তড়িঘড়ি করে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রাতিষ্ঠানিক জনবল সংক্রান্ত ব্যানবেইসের ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে তিনি নিয়ম ভঙ্গ কওে এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সিংড়া উপজেলার জামতলী হাট নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েরও প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। গত বছর এম এ পাশ করা আশরাফুল ইসলাম প্রধান শিক্ষক হলেও প্রতিষ্ঠানের নামফলকে এবং সীলে তিনি নিজের পদবী লেখেন অধ্যক্ষ এবং পরিচয়ও দেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে। রোববার এ বিষয়ে বার বার চেষ্ঠা করলেও আত্মগোপনে থাকায় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি জাহিদুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, দুইজন শিক্ষককে বাদ দিয়ে নতুন দুইজনকে নিয়োগ দেয়া হলেও তিনি কিছুই করেননি, সব করেছেন সভাপতি। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তিনি কিছু বলতে পারেননি। অপর দিকে চারজনের স্থলে ১০জন কর্মচারী নিয়োগ ও ৯জনের সরকারি বেতন চালু করার বিষয়ে বলেন, স্কুল এবং কলেজ আলাদা প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে তিনি এটা করেছেন। এরকম করা যায় মৌখিক ভাবে শুনেছেন দাবী করলেও এমপিও নীতিমালা পরিপন্থি এই কাজের স্বপক্ষে তিনি কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এ সময় তিনি কোন আর্থিক অনিয়মের সাথে জড়িত নন বলেও দাবী করেন। জেলার সরকারি ও বেসরকারি কলেজের মধ্যে সবচেয়ে রাজকীয় ভাবে সজ্জিত তার অফিস কক্ষটি সভাপতি জাহিদুর রহমান জাহিদ করে দিয়েছেন বলেও তিনি দাবী করেন। বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলামের সকল জালিয়াতি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী জানিয়েছেন।