গরু নিয়ে কিছু কথা

// — এবাদত আলী

আমাদের গৃহপালিত যে সকল পশু রয়েছে তার মধ্যে গরুর কদর সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। গরুর মত এমন উপকারি প্রাণি আর দ্বিতীয়টি আছে কি-না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ গরু দ্বারা লাঙ্গল টেনে জমি চাষ করা হয়। গরুর গোবরকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গোবর দ্বারা বায়োগ্যাস প্রকল্পের মাধ্যমে আলো জ্বালানো যায়। গাভীর দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন ছানা, পনির, ঘৃত ইত্যাদি ভক্ষনে আমরা তৃপ্ত হই।
গরু অতি নিরীহ প্রাণি। তবে কেউ বিরক্ত করলে শিং দ্বারা গুতায়। গরুর সঙ্গে তুলনা করে কিংবা গরুকে উপমা হিসাবে কাউকে গো-মুর্খ বল্লে সে মারমুখী হয়ে ওঠে। গরুর জাতি সত্বায় আঘাত করে কাউকে যদি বলা হয় বেটা গরু, তখন সে ব্যক্তিটি অবশ্যই ফোঁস করে তেড়ে আসে। আমাদের দেশে একটি প্রবাদবাক্য আছে জুতা মেরে গরু দান।
অর্থাৎ অপমান অপদস্থ করার পর কাউকে পুণরায় আদর করা। কাউকে যদি বলা হয় গরুর মত মোটা কিংবা ধর্মের ষাঁড়; তাহলে তো কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে দু’ঘা বসিয়ে দেবে। মুক্তভাবে বিচরণশীল ষাঁড়ের ন্যায় স্বেচ্ছাচারি ব্যক্তিকে বলা হয় গকুলের ষাঁড়। গরুর জাত নিয়ে টানাটানি করে অনেকেই উপদেশবাণী শোনায়। যেমন বলা হয় দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভাল। গো-ভাগাড়ে গিয়ে মর বলেও অনেককে আবার তিরস্কার করা হয়ে থাকে।
গরুকে যে ঘরে রাখা হয় তাকে বলা হয় গোশালা। গরু নির্বোধ প্রাণি বলেই হয়তো এরা প্রতিবাদ করে না। তাছাড়া হাতির মত ইয়াবড় জন্তুর আবাসস্থলকে যখন হাতিশালা বলা হয় তখন “গোশালা” শব্দ নিয়ে গরুর কোন মাথা ব্যথ্যা নেই।
পড়ন্ত বিকেলে গরুর পাল হেঁেট গেলে যে ধুলা উড়ে তাকে কবি- সাহিত্যিকগণ নাম দিয়েছেন গোধুলী। কিন্তু ঐ পথে মানুষ ঁেহটে গেলে এবং তা থেকে ধুলা উড়লে মানব ধুলি কেই বলে না। আসলে গরুরা নির্বোধ বলে এরা কোন প্রতিবাদ করে না।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম “দে গরুর গা ধুইয়ে” বলে ব্যাঙ্গ করে গান লিখেছিলেন এবং মাষ্টারস ভয়েস কোম্পানীতে তা রেকর্ড করিয়ে প্রামোফোনে বাজিয়েছিলেন। গরুকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করতে তিনিও কম যাননি। মানব জাতি কারনে অকারনে গরুকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। মুখ গহ্বর বড় করে অর্থাৎ বড় বড় গ্রাস করে খাদ্য ভক্ষণ করলে তাকে বলা হয় গোগ্রাস। যে সাপের ফণায় গরুর খুরের চিহ্নযুক্ত আছে সে সাপকে বলা হয় (গোখুরা) গোখরা সাপ।
নির্বোধ গরু অপরের ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেল্লে, ক্ষেতের মালিক গরুকে খোয়াড়ে দেয়। আসলে খোয়াড়ে তো গরুর মালিককেই দেয়া উচিত।
কারণ গরু নির্বোধ বলে তার কাছে আপন-পরের কোন বালাই নেই। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর এ দেশের দালাল, রাজাকার, আল শামস, আল বদর বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। এমনি একটি অজাচিত ঘটনা ঘটে পাবনা শহরের নুরপর ডাকবাংলো মিলিটারি ক্যাম্পে। স্থানীয় দালাল পাকিস্তানি আর্মিদেরকে তুস্ট করার জন্য রাজাকারদের মাধ্যমে গৃহস্তের বাড়ি থেকে জোর পুর্বক একটি ষাঁড় গরু নিয়ে এনে জবাই করে দুপুর বেলা ভুড়ি ভোজের আয়োজন করে। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগে আর্মি ক্যাম্পের বিশাল সামিয়ানার নিচে খাবার টেবিলে থরে থরে খানা সাজানো হয়। এক পাশে আর্মি অফিসার ও পিস কমিটির দালাল, অপর পাশে রাজাকার, আল বদরেরা বসে কেবলই দু এক লোকমা খাবার মুখে দিয়েছে, সেই মূহুর্তে বালিয়া হালটের জনৈক এক ব্যক্তির একটি ষাঁড় গরু দড়ি ছিঁড়ে লাফাতে লাফাতে হঠাৎ করে আর্মি ক্যাম্পের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ষাঁড় গরুটি শিঙের গুতায় মেইন গেটের দুই সিকিউরিটি গার্ডকে জখম করে খাবারের মজলিসে গিয়ে হাজির হয়। পাকিস্তানি আর্মি অফিসারসহ পিস কমিটির দালাল রাজাকারেরা এহেন আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। গরুটি মূহুর্তের মধ্যে শিঙের গুতায় খাবার টেবিলে রক্ষিত পোলাও সাদা ভাত, আলু ভর্তা, বেগুন ভাজি, গরুর গোস্ত, মুরগির রোস্ট, ভুনা গোস্ত, কিমা, আচার, ডাউল, পায়েস, দইসহ বিভিন্ন পদের খাবার শিঙের গুতায় লন্ড-ভন্ড করে দেয়। ধারালো শিঙের গুতায় আর্মি অফিসার, পিস কমিটির দালাল, রাজাকারসহ সকলের উপরই আক্রমণ চালায়। খাবারের টেবিল ঢুঁ মেরে মেরে উল্টে ফেলে। এতে অনেকেই হতাহত হয়।
পাকিস্তানি আর্মি অফিসার শিঙের গুতায় আহত অবস্থায় পিস কমিটির চেয়ারম্যানকে বলে, ‘‘ চেয়ারম্যান ছাহাব ইয়ে গরু বহুত খতরনাক গরু হায়। উ ভি মুক্তি গরু হায়?
পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই গরু আছে, তাই গরুর কদর সর্বত্র। রামায়নে উেেল্লখ আছে ভারতের সরযু নদীর তীরে অযোধ্যা নগরের রাজা দশরথের পুত্র রাম, সীতা নামের যে কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন; রামের শশুর অর্থাৎ মিথিলার জনক রাজা যিনি গরু দ্বারা লাঙ্গল বাইতে গিয়ে লাঙ্গলের ফলায় সীতাকে পেয়েছিলেন। সেই পালিত কন্যার বিয়ের সময় মেয়ে জামাইকে এক লাখ গরু উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করেছিলেন।
একালেও গরুর কদরের কোন কমতি নেই। বিগত ১৯৯৮ ইং সালের জুন মাসে দক্ষিন কোরিয়ার সেরা ধনী হুন্ডাই গ্রুপের মালিক চুং-জু-ইয়ং উত্তর কোরিয়া সফরকালে ৫ শটি গরুর একটি পাল সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কড়া প্রহরাধীন সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি গরু গুলো উত্তর কোরিয়াকে উপঢৌকন হিসাবে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে এক কালে কৃষকের গোয়াল ভরা গরু ছিল। পরবর্তীকালে এদেশে গরুর ঘাটতি হতে থাকে। অভাবের তাড়নায় কৃষকেরা হালের বলদ ও দুধেল গাই বিক্রি করে তাদের অভাব মিটাতে গিয়ে অধিকাংশ কৃষকের গোয়ালই আজ গরু শুন্য। তা ছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে উনীত হওয়ায় এবং যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের যুগে প্রবেশ করায় হালের বলদের কদর নেই বল্লেই চলে।
এখন যা আছে তা হলো গাভীর দুগ্ধ পান এবং ফি বছর কোরবানীর জন্য বেশিরভাগ গরু লালন-পালন। ইসলাম ধর্ম মতে ঈদুল আজহার চাঁদ উদিত হবার পর নির্ধারিত তারিখে পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের পর উট, দুম্বা, গরু-মহিষ, ভেড়া, ছাগল-বকরি ইত্যাদি হালাল পশু কোরবানী করা হয়। বাংলাদেশে কোরবানীর ক্ষেত্রে অন্যান্য পশুর চাইতে গরুকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেকারণে গরুকে নিয়ে নজির বিহীন কর্মকান্ড
চলে। গরু লালন-পালনকারি গৃহস্ত বা গো খামারিরা ঈদের কোরবানীকে উপলক্ষ করে কয়েক মাস আগে থেকেই গরু মোটা তাজা করার জন্য
কিছু পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওষুধ ব্যবহার করছেন। কৃত্তিমভাবে গরুর মাংসপেশিতে ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে।
এসব গরুর মাংস খেলে মানুষের কিডনী লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ক্যান্সারও হতে পারে বলে চিকিৎসকদের অভিমত।
এসম্পর্কে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকা ১৪ জুন-২০২৪ সংখ্যা লিখেছে ‘‘প্রাণী চিকিৎসক এবং পশু বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসব গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত বলে মন্তব্য করেছেন কয়েকজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ঢাকা চট্রগ্রামসহ বেশ কিছু জেলায় এবার এমন কিছু পশুর দাম হাঁকা হচ্ছে যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। সামাজিক মাধ্যম ও টেলিভিশন মিডিয়ায় বিভিন্ন নাম দিয়ে এসব পশু কোরবানীর জন্য কেনাবেচা হচ্ছে। আগের বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় গরু বিক্রি হলে সেটা দেশ ব্যাপি আলোচিত হতো। তবে এবার কোটি
টাকায় একটি গরু বিক্রির কথা বলা হচ্ছে। রাজধানীতে সাদেক অ্যাগ্রো নামে একটি ফার্ম গত সোমবার ব্রাহামা জাতের তিনটি গরু ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। এর মধ্যে দুটি গরুর

দামই ছিলো ২ কোটি টাকা। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়। ঢাকার বাইরে থেকেও বাহারি নামে বেশি দামে গরু বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। চিত্র নায়ক সাকিব খান, জায়েদ খান, সালমান খান এবং চিত্র নায়িকা পরিমণির নামেও গরু বিক্রি হচ্ছে হাটগুলোতে। এছাড়া বাংলার রাজা , কালো মানিক, সুলতান, নবাব নামে বেশি দামে গরু বিক্রয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে হাটগুলো থেকে। অনেক বেশি দাম দিয়ে কোরবানী পশু ক্রয়ের বিষয়ে ইসলামী ঔক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফায়জুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে বলেন,ইবাদত হতে হবে লৌকিকতা মুক্ত। সেটি যে কোন ইবাদতই হোকনা কেন। তবে ভালো নিয়তে কেউ যদি প্রতিযোগিতা করে সেটি অন্য কথা। কিন্তু মানুষকে দেখানোর জন্য, যশ খ্যাতি লাভের জন্য নিজের বড়ত্ব প্রকাশের জন্য কেউ যদি কোরবানী করে সেটি যথার্থ ইবাদত হিসেবে গণ্য হবেনা। ’’
আগেই বলা হয়েছে গরু নির্বোধ প্রাণি। তাকে মোটা তাজা করণের জন্য নিষিদ্ধ টেবলেটসহ যে খাদ্য খাওয়ানো হয় সে তাই গোগ্রাসে খায়। তার দাম কোটি টাকা হলেও সে কখনো আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফাল পাড়েনা। নায়ক নায়িকাদের নামে তাদেরকে ডাকা হলেও তাদের কোন প্রতিক্রিয়া কেউ কোনদিন দেখেনি। বিগত ১১ জুলাই-২০২২ বগুড়া শহরে সাড়ে চার লাখ টাকার একটি ষাঁড়ের নাম রাখা হয়েছিলো হিরো আলম। পত্রিকার হেডিংয়ে বলা হয়েছিলো ঈদের দ্বিতীয় দিনে কোরবানী হলো হিরো আলম। এসব বুঝে শুনেও নির্বোধ গরু তাই চুপ করে থাকে, আর ভারত ভুভাগের পন্ডিত ঈশ^ও চন্দ্র বিদ্যাসাগরের কবিতার দু লাইন জাবর কাটার ভঙ্গিতে আওড়ায় ‘‘জেনে রেখো এ জগতে সকলেই গরু যে যারে ঠকাতে পারে সেই তার গুরু।” লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সদস্য, পাবনা প্রেসক্লাব,
পাবনা। তারিখ: ১৫/০৬/২০২৪