// কোলাহলপূর্ণ ইট-পাথরের নগরে যাদের বাস, চোখ ভরে সবুজ দেখার সুযোগ তাদের কই! কিন্তু এর মাঝেও সবুজপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে বারান্দা বা ছাদবাগান তৈরির মাধ্যমে। শহুরে জীবন ভীষণ অস্থির। বুলেট গতিতে ছুটে চলা জীবনযাপনে অভ্যস্ততা এলেও দিনশেষে খানিকটা হলেও স্বস্তি চান কমবেশি সবাই। জীবনের এই গতিতে, মানুষের মাঝে নানা ধরনের চাপ এবং মানসিকভাবেও একপ্রকার অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে।
এমন যান্ত্রিক জীবনযাপনে মনের যত্ন নেওয়ার সময় নেই কারো। তবে মনের যত্নের স্বার্থে এবং শহরের যান্ত্রিক জীবনধারা থেকে মুক্তি পেতে প্রকৃতির সবুজ আলিঙ্গনে ফিরে আসার একমাত্র পথ হতে পারে বারান্দায় বা ছাদে একটুখানি হলেও সবুজ রোপণ করা। বলছিলাম ছাদবাগান বা বারান্দা বাগানের কথা। মানসিক স্বস্তির জন্য সবুজের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন।
মনের যত্নে বাগান করুন
যাপিত জীবনের ক্লান্তি, অবসাদকে নিমেষেই মিলিয়ে দিতে পারেন যদি সবুজের মাঝে কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। ভীষণ অস্থির হয়ে আছে মন, এমন অবস্থায় কিছুটা সময় নিন। বড় বড় নিঃশ্বাস নিন, তাকিয়ে থাকুন বারান্দার গাছগুলোর দিকে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিন, দেখবেন মুহূর্তেই অস্থিরতা হাওয়া।
বলা হয়, পরিবারের নিরাপদ খাদ্য চাহিদা মেটাতে এবং প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে বারান্দায় বা ছাদে বাগান করা বেশ ভালো সমাধান। অস্থির সময়ে মানসিক স্বস্তি দিতে এর চেয়ে ভালো দাওয়াই আর হতেই পারে না। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে স্বস্তি মেলে না এতটুকুও। ছাদবাগান বাড়ির সবচেয়ে ওপরের ফ্লোরকে রাখে তুলনামূলকভাবে শীতল।
সেই সঙ্গে দূষণমুক্ত রাখে পরিবেশও। অক্সিজেন বৃদ্ধিতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাই বারান্দায় বা ছাদে বাগান তৈরির কোনো বিকল্প নেই।
সকালটা শুরু করুন বাগান দিয়ে
সকালে ঘুম থেকে উঠে কিংবা সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর কিছু সময়ের জন্য সবুজের কাছাকাছি গেলে মানসিক প্রশান্তি কাজ করে। ফলে মেজাজ থাকে ফুরফুরে এবং কাজেও মন বসে। দিনের শুরুতেই যদি বারান্দা বা ছাদের বাগানে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতে পারেন তাহলে দিনটাই চমৎকার হয়ে উঠবে। নিজের লাগানো গাছে নতুন নতুন ফুল, ফল সবজি হচ্ছে এমনটা দেখাও বেশ আনন্দের। আবার পড়ন্ত বিকেলে বাগানটা মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির নিরবচ্ছিন্ন সৌন্দর্য।
শীতল ছায়ার নিশ্চিতকরণ কিংবা পশু-পাখির আশ্রয়স্থল হিসেবেও শহুরে যান্ত্রিক জীবনে প্রকৃতির সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর মাধ্যমে মনোরম পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে। কেবল পরিবারের বড় সদস্যরাই বাগান করবে বিষয়টি এমন নয়। বরং বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যদেরও যুক্ত করা যেতে পারে এর সঙ্গে। শিশুদের বাগান করার কাজে লাগালে তাদের শেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
বাগান করার বাড়তি পাওনা
বর্তমান সময়ে ফরমালিনমুক্ত শাকসবজি কিংবা ফলমূল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাজারে যা পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই রাসায়নিক সার এবং ফরমালিনযুক্ত। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। সৌন্দর্যবর্ধক ফুল গাছ, বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাক-সবজি, ফলমূল, ঔষধি গাছ ছাদবাগানে চাষ করা যায়। এতে একটি পরিবারের অর্থনৈতিক চাপ কমানো এবং পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব। গাছপালা লাগিয়ে যখন নিজেরাই সবজি, ফলমূল উৎপাদন করতে পারি, তখন বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যায়। পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও বাড়ে।
বাগানের যত্নে যা করবেন
গাছপ্রেমী মানুষের জন্য ছাদবাগান একপ্রকার শখও বটে। তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে ছাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। জেনে নিন ছাদবাগানের যত্নের সাধারণ কিছু নিয়ম নিয়ে।
প্রথমেই ছাদের উপযোগী গাছ কোনগুলো সেগুলো মাথায় রেখে গাছ কত বড় হবে সেই অনুযায়ী টবের আকার নির্ধারণ করতে হবে।
মাটির তৈরি টব বেশি জনপ্রিয়। তবে বড় গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ড্রাম ব্যবহার করা উত্তম।
সরাসরি ছাদের মেঝেতে গাছের টব না রেখে কিছুটা উঁচুতে কিংবা ইটের ওপর রাখা যেতে পারে। এতে ছাদ ময়লা/স্যাঁতসেঁতে হবে না। ছাদ ভালো থাকবে এবং দেখতেও সুন্দর লাগবে।
নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সারিবদ্ধভাবে গাছগুলোকে লাগাতে হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে ছাদের সাইডে গাছের টব রাখা থেকে বিরত থাকা উচিত। নতুবা বাতাসে বা ঝড়ের কারণে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
নার্সারিতে আজকাল ফলের গুটি কলম, চোখ কলম ও জোড় কলম পাওয়া যাচ্ছে। বীজের চারার চেয়ে ছাদবাগানের জন্য এসব কলমের চারা উত্তম।
সূর্যের আলো কোন গাছগুলোতে বেশি পড়বে এবং কোন গাছগুলোতে ছায়া পড়বে সেদিক বিবেচনা করে বাগানের নকশা তৈরি করতে হবে। বাতাসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেড়া দেওয়া যেতে পারে।
সাধারণত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটিতে গাছ ভালো জন্মে। মাটিতে গোবর সার, কম্পোস্ট ও রাসায়নিক সার পরিমাণমতো মেশাতে হবে গাছের খাদ্যপুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য। ডিমের খোসা, উচ্ছিষ্ট চা পাতা শুকিয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
সকালে ও বিকালে গাছে পানি দিতে হবে। ভরদুপুরে বা কড়া রোদে নতুন চারা লাগানো কিংবা গাছে পানি দেওয়া এবং বালাইনাশক প্রয়োগ করা উচিত নয়।
পানি জমতে দেওয়া যাবে না। কোনোভাবেই ছাদ যেন স্যাঁতসেঁতে হতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পানি জমে থাকলে এতে মশার বাসস্থান তৈরি হবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে।
ছাদবাগানের কিছু উপকরণ এবং যন্ত্রপাতি, যেমন কোদাল, শাবল, মাটি চালার চালনি, বেলচা, কাঁচি, খুরপি ব্যবহার করলে ছাদবাগান করা সহজ হয়। মাটিতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদান, কাচ বা খুচ থাকতে পারে। দুর্ঘটনা এড়াতে বাগানের পরিচর্যার জন্য গ্লাভস পরা উচিত।
মগে বা বালতিতে করে পানি দেওয়া সময়ের ব্যাপার। ওয়াটার ক্যান ব্যবহারের মাধ্যমে সমানভাবে গাছগুলোতে পানি পৌঁছয়, সময়ও কম লাগে। বর্ষাকালে মাসে অন্তত দুইবার ছত্রাকনাশক স্প্রে প্রয়োগ করতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে গেলে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। গাছের গোড়ায় যেসব আগাছা জন্মায় সেগুলো কেটে দিতে হবে। এতে গাছপালা রোগমুক্ত থাকবে এবং গাছের গোড়ায় ঠিকমতো সূর্যের আলো পৌঁছবে।
স্বাস্থ্যকর এবং দূষণমুক্ত একটি পরিবেশে থাকার জন্য ছাদবাগান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর আগামী বেড়ে উঠুক সবুজের পরশে। ইট-পাথরে শহরে প্রাণ ফিরে আসুক সবুজ বৃক্ষের সজীবতায়।