আবু সাঈদ ফরিদ খান ::
নজরুল প্রমীলা পরিষদ আয়োজিত ঈদ মিলন মেলায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আত্নার মাগফিরাত কামনায় দূ’আ ও কিছু কথাঃ
৩০ শের দশকে উর্দু ভাষার কাওয়ালি গান ছাড়া বাংলা ভাষার তেমন কোনো ইসলামি গান ছিলো না। তখন সঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ বাংলা ভাষায় ইসলামি গানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ জনপ্রিয় এই ইসলামি গান রচনা ও সুরারোপ করেন। গানটি প্রথম শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠেই রেকর্ড হয়। সঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমেদের অনেক অনুরোধে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল ইনচার্জ ভগবতী বাবু ইসলামি গান রেকর্ড করতে সম্মত হন। ১৯৩২ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে। গানের রেকর্ড প্রকাশের পরপরই এক মাস রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ উল ফিতরের এই গানটি মুসলিম সমাজে ব্যপক ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও রোজার শেষে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ জনপ্রিয় এই ইসলামি গানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে ব্যপক ভাবে প্রচার হতো। এখন আমাদের মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বঙ্গবন্ধু কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেশে এনেছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়েছেন চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।
কবির মৃত্যুর পর তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাপ্রধান কবির শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী কবিকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় সম্মানে সম্মানিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবিকে কবর দিয়েছেন। সুখের কথা আমাদের মাতৃভূমি এখন অনেক এগিয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্থলে অসংখ্য টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেল হয়েছে। দুখের কথা কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ জনপ্রিয় এই গানটি আগের মতো প্রচার করা হচ্ছে না।
আমাদের দেশে আগের দিনে নিম্নবিত্ত মুসলিম পরিবারে বর্তমান সময়ের মতো এতো বাহারি খানাদানা বা ইফতার চিন্তাও করা যায়নি। ভাত পানি নিরামিষ মুড়ি সম্ভব হলে কাঁচা ছোলা দিয়েই ইফতার করা হতো। পরবর্তীতে ধীরেধীরে ইফতারে তেলমশলা সমৃদ্ধ খাবার যুক্ত হয়। বেশি দিন আগের কথা নয়, শহরেও ঘরে-ঘরে ফ্রিজ ছিলো না। ঢাকা শহরের অলিগলিতে বরফ পাটা খন্ড খন্ড করে ভেঙে বিক্রি করা হতো। গরমে রোজাদারদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য সেই বরফ খন্ড কিনে নিয়ে পানি বা শরবতের সাথে মিশিয়ে পান করতেন। এভাবেই দেশের মানুষ একমাস রোজা পালন করেছে। শেষ রোজায় দিনের শেষে মাগরিবের আগে-পরে সব এলাকার মুরুব্বি তরুণ-যুবক ও ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে দাঁড়িয়ে মিলেমিশে আকাশের দিকে তাকিয়ে শাওয়াল মাসের ঈদের চাঁদ দেখতেন। এই চাঁদ দেখার মাঝে ছিলো অন্যরকম আনন্দ। চাঁদ দেখার পরই কবি নজরুলের ঈদের জনপ্রিয় গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ প্রচার করা হতো। যাদের ঘরে বা দোকানপাটে রেডিও টেলিভিশন ছিলো তাঁদের ওখান থেকে এই সুমধুর গান শোনা যেতো। এই গান শোনার সাথেসাথে ঈদ আনন্দে মন ভরে যেতো। দেশের সাধারণ মুসলিম পরিবারগুলোতে সবসময় নতুন পোশাকাশাক কেনা হতো না। এবং সবসময় ভালো মানের খাবারও তৈরি হতো না। ঈদ উপলক্ষে যেসকল পরিবারের ছেলেমেয়েরা নতুন জামাকাপড় পেতো তাঁদের আনন্দ ছিলো সবচেয়ে বেশি। চাঁদ দেখে মেহেদি পাতা বেটে হাতে মেহেদি লাগানো ছিলো আরেক রকম আনন্দ। নিম্নবিত্ত মুসলিম পরিবারগুলোতে ঈদ সামনে রেখে সাধ্যানুসারে বছরে একবার হলেও একটু ভালো মানের খাবার তৈরি করার মাধ্যমে ঈদ উদযাপন করা হতো। সেইসাথে নিকটবর্তী আত্নীয় পাড়াপ্রতিবেশি একে অপরের বাড়ি ঈদের দিন আসাযাওয়া করতেন। এই আসাযাওয়ার মাধ্যমে পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনায় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হতো। আমাদের দেশের সামাজিক অবক্ষয় দূর করার জন্য এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করা দরকার।
১১ এপ্রিল ২০২৪ ঈদ উল ফিতরের দিন বিকেল ৪ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমাধিসৌধে নজরুল প্রমীলা পরিষদ আয়োজিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের গান পরিবেশ, আলোচনা ও জাতীয় কবির আত্নার মাগফিরাত কামনায় দূ’আ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাট্যব্যক্তিত্ব এডভোকেট লুৎফুল আহসান বাবু এবং সঞ্চালনায় ছিলেন ডাঃ মুক্তাদীর। বাংলা একাডেমির সদস্য কবি সৈয়দ নাজমুল আহসানের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সভায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আত্নার মাগফিরাত কামনা করে দূ’আ ও মোনাজাত করেন ছড়াকার ফরিদ সাইদ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আফতাবুজ্জামান, ডেপুটি রেজিস্ট্রার প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) এর অফিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যনির্মাতা নূর হোসেন রানা, আলমগীর শিকদার লোটন, কচিপাতা সম্পাদক আলেয়া বেগম আলো, কবি ও সংগঠক মমিন মেহেদী, কথাসাহিত্যিক শান্তা ফারজানা, কবি শেফালি দৌসি, রিয়াদ মাহমুদ খান, কবি জুলফিকার স্বপন, কবি আবদুস সালাম চৌধুরী, কবি শাহাজাদা সেলিম, নীলা রহমান, ফারজানা রাখি, আজিম উদ্দিন, কবি সায়মা খাতুন রিভা, গোধূলি, নাসরিন আক্তার, মোস্তাফিজ সুজন, রোমানা আক্তার, মো. ওমর, মো. মনির, মো. সোলায়মান সহজ,মো. ইকবাল, আবুবকর প্রমুখ। ঈদের দিন পরিবার ফেলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভালোবাসায় অনেক নজরুলপ্রেমিরা কবি নজরুল সমাধিসৌধে উপস্থিত হন।
আমাদের মাঝে যেসকল প্রিয়জন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভালোবাসেন, কবি নজরুলের গান কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক সিনেমা নিয়ে কাজ করেন। সেই সকল প্রিয়জনদের প্রতি কবি নজরুলের গান কবিতা সমাজগঠনমূলক ভালো ভালো লেখা ব্যপক ভাবে প্রচারের মাধ্যমে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যথাযথ সম্মানের অনুরোধ রইলো।