বাল্যকালের ঈদ আনন্দ

— এবাদত আলী —
ঈদ শব্দের অর্থ হলো খুশি। আর ঈদের খুশির আমেজ ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে যেমন বড়দের বেলায় ঠিক ততটা নয় বলেই মনে হয় । বাল্যকালের ঈদ আনন্দের কথা ভাবতে গিয়ে বার বার সেই সব স্মৃতিই মনে পড়ে । ফি বছর দুটি ঈদ। একটি ঈদুল ফিতর অপরটি ঈদুল আজহা। আরবি রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেলে সেরাতে এশা নামাজের পর তারাবি নামাজ আদায় এবং পরদিন সারাদিন রোজা রাখার নিয়তে শেষ রাতে সাহরি খাওয়া। এভাবে এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হতো। আপাতঃদৃষ্টে ঈদুল আজহার চেয়ে ইদুল ফিতরের আমেজ একটু বেশি বলে মনে হতো।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকের কথা। পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের বাদলপাড়া আমাদের গ্রাম। গ্রামের লোকেরা তখনো ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেনি। তবে রমজান মাসের চাঁদ দেখা মাত্রই এশা নামাজের পর পরই ২০ রাকাত তারাবিহ এর নামাজ আদায় শুরু হয়। মসজিদের আশে পাশের মুসুল্লীগণ মসজিদে এবং দুরের মুসুল্লীরা নিজ বাড়ির বৈঠকখানা বা বাইরের আঙিনায় অর্থাৎ খোলার উপরে খেজুেরর পাতার বুনানী পাটি কিংবা চট বিছিয়ে জামায়াতে নামাজ আদায় করতেন। তারা অজু করার জন্য পাতকুয়ার পানি লোটা কিংবা মাটির বদনায় নিয়ে অজু করতেন। তাদের অজুর নিয়ত ছিলো এ রকম ‘‘ অজু করলাম তজু করলাম রুমালে মুছলাম হাত, আবে জমজমের পানি দিয়ে দেহ করলাম সাফ’’।
শেষ রাতে সাহরি রান্না ও খাবারের জন্য এলাকার যুবক ছেলেরা দল বেঁধে হাঁকডাক শুরু করে দিতো। তারা টিনের চোঙায় মুখ লাগিয়ে সুর করে গজল গাইতো। এতে সকলেরই ঘুম ভেঙে যেতো। রোজা শেষে তারা বকশিশ লাভ করতো।। এভাবেই নির্দিষ্ট সময়ে সাহরি ও ইফতারির মধ্য দিয়ে চলে এক মাস সিয়াম সাধনা। এরপর শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে পর দিন ঈদুল ফিতর।
সেসময় ঈদ এলে দেশময় পাড়া ময় ছড়িয়ে পড়ে ঈদের আমেজ। ঈদ এলে প্রায় সকলের জন্যই নতুন জামাকাপড় চাইই চাই। ছেলেদের জন্য পাজামা পাঞ্জাবি আর মেয়েদের জন্য রকমারি পোষাকের প্রচলন ছিলো তখনো। তার সাথে আলতা কুম কুম আর হিমানী পাউডারের ব্যবহার ছিলো সমান তালে । সামর্থহীন পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পুরাতন কাপড় পরেই ঈদ করতো। বছরান্তে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সেদিন গোশত খাবার জন্য গ্রামের লোকেরা হারি-চাঁদা তুলে ভাগে মহিষ কিনে গোশত ভাগাভাগি করে নিতো। তাতে ১ ধড়া অর্থাৎ ৫ কেজি গোশত ১ টাকাতেই মিলে যেতো।
ঈদের কদিন আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি ঠেঁকিতে আতপ চাউলের গুঁড়া তৈরির ধুম পড়ে যেতো । ঈদে মেয়ে জামাই আত্মীয় কুটুম যারা আসবে তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির জন্যই আতপ চাউলের গুঁড়ার ব্যবস্থা করা হতো । তখন গোস্ত রুটি আর হাতে প্রস্তুত কৃত সেমাইয়ের প্রচলন ছিলো খুব বেশি। চাউলের গুঁড়া গরম পানিতে গুলিয়ে খামির তৈরি করে তা পিঁড়ির উপর রেখে হাতের তালুর সাহায্যে সেমাই প্রস্তুত করা হতো । স্থানীয় ভাষায় একে বলা হতো সেমাই বা ছই । এই সেমাই রোদে শুকিয়ে তা তুলে রাখাা হতো। ঈদের দিন সকালে খেজুরের কিংবা আখের গুড় ও গরুর খাটি দুধ দিয়ে তা পাক করা হতো । এদিন আমাদের বাড়িতে সেমাই ও পোলাও সহ ভালো খাবারের ব্যবস্থা হতো ।
ঈদের আগের রাতে আমাদের ভালো করে ঘুম হতোনা । কখন যে রাত পোহাবে এই আশায় হৃদয় মন রোমাঞ্চে ভরপুর থাকতো । ঈদের দিন সকালে বাড়ির উত্তর পাশের বাঙ্গর নদীতে দল বেধে গোসল সেরে পাজামা আচকান বা শেরওয়ানি পরতাম । মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ নামক টুপি এবং পায়ে চপ্পল পরতাম । অনেকে ঝুলওয়ালা টার্কিশ টুপি পরতো । কাপড়ের তৈরি কিস্তি ও পাঁচকলিদারি টুপিরও প্রচলন ছিলো । বৃদ্ধ বয়সের লোকেরা কলিদারি পাঞ্জাবি ও টুপি পরতেন এবং লাকড়া লাগানো খড়ম পায়ে চটর মটর শব্দে ঈদগাহের পথে চলতেন ।
জামা কাপড় পরা শেষ হলে বড় বোন আমার চোখে সুরমা লাগিয়ে দিতেন এবং আব্বা তুলায় করে আতর দিতেন, যা দু কানের লতির কাছে গুঁজে রাখতাম । বাড়ি থেকে ঈদগাহের দুরত্ব ছিলো ঢের । রোদের তাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রায় সকলেই ছাতা মাথায় দিতো এবং দিন মজুরেরা মাথায় লাল গামছা জড়িয়ে নিতো। দাপুনিয়া হাট থেকে সামান্য দুরত্বে পদ্মা নদীর শাখা মলম বেপারির কোল এর পাশে ছিলো কৈটাপাড়া গ্রামের ঈদগাহ মাঠ । ঈদগাহের মাঠ জুড়ে বড় বড় আম গাছের ঝাঁকড়া ডাল পালার নিচে গিয়ে সকলে বাঁশের খলপা বা চাটাইয়ের উপর বসতো । সামনের দিকে দু একটা কাতারে চটের ব্যবস্থা থাকতো । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামের মাতব্বর শ্রেণির লোক -দু একজন হাজী কিংবা অতি বয়স্ক ব্যক্তি চটের উপর বসতেন ।
শিবপুর কদম বগদীর (পাবনা জেলার আটঘরিয়া থানাধীন) মওলানা আবদুল্লাহ হুজুর ঈদের নামাজ পড়াতেন এবং নামাজের আগে মিম্বরের পাশে দাঁড়িয়ে মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে সুর করে ওয়াজ নছিহত করতেন এবং ছয় তাকবিরের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের নামাজ কিভাবে আদায় করতে হবে তা শিখিয়ে দিতেন। নামাজ শেষে মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা পাঠ করতেন। তখন মাইকের ব্যবহার সবেমাত্র শুরু হয়েছে । বিয়ে এবং সুন্নতে খাতনার গোসলের দিন গ্রামের অবস্থাপন্ন লোকেরা কলেরগানের সাথে মাইক বাজাতো । ঈদগাহ কমিটির পক্ষ থেকে ঈদের মাঠে হুজুরের বয়ান ও খোতবা শোনার জন্য মাইক আনতে চাইলে মওলানা সাহেব অনুমতি দিতেননা । তিনি বলতেন – যে মাইকে কলের গান বাজানো হয় সেই মাইক দ্বারা নামাজের আজান দেওয়া ওয়াজ নছিহত সহ খুতবা পাঠ করা সম্পূর্ণরুপে নাজায়েজ । এতে কষ্ট তারই বেশি হতো । প্রচুর সংখ্যক লোককে খুতবা ও ঈদের মাসলা মাসায়েল শোনাতে গিয়ে তাঁর কন্ঠনালীর রগ টান টান হয়ে উঠতো । নামাজ শেষে কোলা কুলি চলতো। বাড়ি ফিরে মুরুব্বিদেরকে কদমবুচি করতাম । মুরুব্বিগন পিঠে হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন । কদমবুচি করলে বকশিশ মিলতো।
এরপর গ্রামের সমাজ পতি বা সমাজের প্রধানের বৈঠক খানা বা কাচারি ঘরে প্রায় প্রতিটি বাড়ি হতেই খিচুড়ি সিন্নি আসতো যা সকলে মিলে চট কিংবা মাছ ধরার ‘বানা’র উপরে সারিবদ্ধভাবে বসে কলার পাতায় রেখে ভাগ করে খেতো । অতঃপর যে যার বাড়ির পথ ধরতো ।
ঈদের দিন আমরা এ বাড়ি ও বাড়ি ছুটাছুটি করতাম। সমবয়সিদের সাথে নানা ধরনের খেলাধুলা করতাম। এক সময় সাঁঝ নামলে বাড়ি ফিরতাম । মায়ের কাছে চুলার পাশে পিঁড়ির ওপর বসে
গরম ভাপ ওয়ালা মহিষের গোশত মজা করে খেতাম। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ০৯/০৪/২০২৪.