একজন কবি লতিফ জোয়ার্দার

// এস এম আবুল বাশার

২০১০ সালে  চাকরিতে পদোন্নতি ও পদায়নসূত্রে পাবনা যাই সপরিবারে। অন্য জায়গায় বিকল্প পদায়নের সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি বেছে নিই পাবনা। সেখানে আমার দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার মধ্যে সবচেয়ে কাছের মানুষ কবি ও কথাশিল্পী আখতার জামান। বলা যায়, তার কারণেই পাবনা বেছে নেয়া। আখতারের মাধ্যমেই পাবনার বিভিন্ন সুধীজন, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী, সংগঠক, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, লিটলম্যাগ কর্মীর সাথে আমার পরিচয় এবং ধীরে ধীরে তাদের সাথে আত্মিকবন্ধনে জড়িয়ে পড়া। তাদেরই একজন কবি, কথাশিল্পী ও সম্পাদক লতিফ জোয়ার্দার। সম্ভবত ২০১১ সালে কবি ও সাহিত্য সংগঠক রেহানা সুলতানা শিল্পীর একটি অনুষ্ঠানে তার সাথে প্রথম পরিচয়। রেহানা তখন এডওয়ার্ডে পড়ে। আমি শহীদ বুলবুল কলেজের শিক্ষক। সে আমাকে যথেষ্ঠ সমীহ করে। আমিও তাকে আজও আমার একজন ছাত্রীর মতোই দেখি ও পছন্দ করি। শিল্পী একজন সফল সাহিত্য সংগঠক। সে সময়েই সে অনেক বড় বড় প্রোগ্রাম সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। অনুষ্ঠান শেষে কথা হয়েছিল লতিফ জোয়ার্দারের সাথে। তিনি কবিতা লেখেন, গল্প-উপন্যাস লেখেন। ছোটকাগজ ‘চৌকাঠ’ সম্পাদনা করেন। প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের যে কটি নাম বললেন, কোনোটাই আমার মনঃপুত হয়নি। সবই জনপ্রিয় ধারার। তাও নাকি এই মফস্বলে শ পাঁচেক কপির বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। বিশ্বাস করা যায়! ব্যাপারটাতে আমি মোটেও গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু যখন জানতে পারলাম, মুলাডুলি থেকেই তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘শূন্য দশকের গল্প’, তখন বইয়ের কপিটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বিস্মিতই হলাম। এই মফস্বলে থেকেও এতো সুন্দর কাজ করা সম্ভব! বাংলাদেশে তখন পর্যন্ত কেউ শূন্য দশকের ছোটগল্প সম্পাদনা করেন নি। দেখলাম, তাঁর ‘চৌকাঠ’ ছোটকাগজের সংখ্যাটিও হাতে নিয়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার দুঃসাধ্য কারো নেই। পত্রিকায় তেমন কোনো বিজ্ঞাপন নেই। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে তিনি ‘শূন্য দশকের গল্প’ সম্পাদনা করেছেন। ‘চৌকাঠ’ সম্পাদনা করছেন। অথচ লেখালেখি ছাড়া তাঁর আর কোনো পেশাও নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু জমি পেয়েছেন। তাঁর বৃদ্ধ মাতা, স্ত্রী ও নিজের তত্ত্বাবধানে তাতে যে ফসল ফলে, তা দিয়ে সংসার চলে। পত্রিকার ব্যয় মেটানো হয়। সংসারে তাঁর দুটি ছেলেমেয়ে। লেখাপড়া করে। তারপরও তাঁর মমতাময়ী মা ও গুণবতী স্ত্রী দুর্মূল্যের বাজারে এই উটকো ঝামেলা মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সংসারের টানাপড়েনের মাঝে ‘চৌকাঠ’ এর ব্যয় কীভাবে মেটান? তিনি হাসিমুখে বললেন, প্রতি বছর একটি করে ছাগল কিনি। লালনপালন করে বড় করি। তারপর হাটে বিক্রি করে যে লাভ পাই তা দিয়েই ‘চৌকাঠ’ এর খরচ মেটাই। আমি তো থ! এভাবেও মানুষ ছোটকাগজ করে তাহলে এই মফস্বলে! এই হলেন লতিফ জোয়ার্দার! আপাদমস্তক সাহিত্যপ্রেমী ও কর্মী। যত মন্দ সময়ই আসুক আপোষ করেন না। কে কী বললো, তাতেও তাঁর কিছু আসে-যায় না। আপন মনে করে যান নিজের কাজ। মানুষ হিসাবেও তিনি যথেষ্ঠ সরল। বন্ধু হিতৈষী। কেউ তাঁকে গালমন্দ করলে বা নিন্দা করলে তিনি মুখ বুজে সয়ে যান। অভিমানে তার সাথে হয়তো কথা বলেন না। নীরবে এড়িয়ে যান। কিন্তু কখনো মারমুখি হয়ে উঠেন না। দীর্ঘদিন সেই অভিমান পুষেও রাখেন না। আবার হাসিমুখে তাকে বুকে টেনে নিলেই তিনি ভুলে যান সব।

লতিফ জোয়ার্দারের আমন্ত্রণে অনেকবার আখতার জামান ও মোখলেছ মুকুলের সাথে মুলাডুলি গিয়েছি। তারা দুজনেই কবি ও কথাশিল্পী এবং আমার অতি নিকটজন। লতিফ জোয়ার্দারেরও। আমরা গেলেই তিনি সাদরে গ্রহণ করতেন। প্রাণখুলে আপ্যায়ন করতেন। আমরা বসতাম রেললাইন সংলগ্ন ‘সবুজস্বর্গ’ নামক ছোট্ট একটি ঘরে। এখানে বসেই তিনি লেখালেখিও পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কেউ এলে তাকে নিয়ে আড্ডা দিতেন। রুমটি ছোট হলেও ছিমছাম গোছানো। তাকে তাকে সাজানো বই। দেখলেই ভালো লাগতো। তবে এ নামে তিনি আরেকটি লিটলম্যাগ করছেন। কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েও গেছে পত্রিকাটির। 

সবুজস্বর্গ থেকে একটু হেঁটে পশ্চিম দিকে গেলে প্যারিস রোড। ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা একটি প্রশস্ত সরল রাস্তা চলে গেছে ঈশ্বরদীর দিকে। লোকজনের চলাচল কম। অনেকটাই নিরিবিলি। এই মনোহর রাস্তা ধরে বিকালের নির্মল আলোয় হেঁটে হেঁটে আমরা চলে যেতাম অনেক দূর। আবার ফিরে আসতাম সবুজস্বর্গ’র দিকে। রাস্তার আশপাশের অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে গল্প করতে করতে যেতে-আসতে আমাদের মোটেও ক্লান্তিবোধ হতো না। মনে হতো আরও কিছুক্ষণ হাঁটি। প্যারিস রোডের মতো এতো সুন্দর রাস্তা বাংলাদেশের আর কোনো জেলায় আছে কি না আমার জানা নেই। মুলাডুলির পাশেই রাজাপুর। রাজাপুর হাই স্কুলসংলগ্ন বিরাট মাঠ। সেই মাঠে প্রতি বছর জমজমাট বইমেলা হয়। আমরা জানতাম না। লতিফ জোয়ার্দার আমাদের কয়েকবার অতিথি করে নিয়ে গিয়েছেন। মেলার পরিসর, লোকজনের সমাগম দেখে আমাদের সবার চোখ  ছানাবড়া। এখানেও এতো বড় বইমেলা হয়! বিরাট মঞ্চে উঠে খুব সংকোচবোধ হতো। মঞ্চের তুলনায় নিজেকে খুব  ক্ষুদ্র মনে হতো।

 মেলায় লতিফ জোয়ার্দারের বুক স্টল থাকতো। সেখানে ক্রেতা-পাঠকদের উপচেপড়া ভীড়। টিনেজ পাঠকই বেশি। তাদের আগ্রহ দেখে তখন আর অবিশ্বাস হতো না, লতিফ জোয়ার্দারের শ’ পাঁচেক বই এ মেলায় বিক্রি হতে পারে। 

বগুড়া বাংলাদেশের আরেকটি বৃহত্তর ছাপাখানার বাজার। অল্প খরচেই এখানে ভালো মানের বই, ম্যাগাজিন বা ছাপার কাজ করা যায়। লতিফ জোয়ার্দার এখান থেকেই বই-ম্যাগাজিন ছাপান দীর্ঘদিন। ফলে ছাপাখানা কর্মী, বগুড়ার সাহিত্য সংগঠক, কবি-সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর দহরমমহরম ভাব। তাঁর মাধ্যমেই পরিচয় হয় কবি ও প্রাবন্ধিক শিবলী মোকতাদির, কথাশিল্পী ও ছোটকাগজ সম্পাদক কবীর রানা, কথাশিল্পী হোসনে আরা মণি, সাংবাদিক, কবি, কথাশিল্পী ও ছোটকাগজ অপরাজিতা’র সম্পাদক নাহিদ হাসান রবিনসহ অন্য অনেকের সাথে। তাঁদের প্রত্যেকের সাথেই গড়ে উঠেছে আত্মার অনিঃশেষ বন্ধন। নাহিদ হাসান রবিন তো অপরাজিতার পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে ছোটগল্পের জন্য আমাকে সম্মাননাও দিয়েছেন। এই সব মানুষের মুখ যখনই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, তখন মনে পড়ে লতিফ জোয়ার্দারের কথা।

জনপ্রিয় ও সিরিয়াস ধারায় গল্প-উপন্যাস লিখছেন লতিফ জোয়ার্দার। তাঁর অনেক সিরিয়াস গল্প আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখেছি, পাবনার বিশেষ করে তাঁর জন্মভুঁই মুলাডুলির মাটি ও মানুষের গন্ধ মিশে থাকে তাতে। তাদের জীবনযাপন ও মুখের ভাষা খুব নিপুণভাবে তুলে আনতে পারেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে। কালের বিচারে তাঁর সাহিত্য টিকবে কি টিকবে না, তা অনেক পরের বিষয়। কিন্তু সাহিত্যে এমন একজন আত্মনিবেদিত ত্যাগী মানুষ এ যুগে খুঁজে পাওয়া বিরল। বন্ধুত্বে তিনি সহজ-সরল ও উদার। এ কারণেই তাঁর সমকালে মফস্বলের গণ্ডি পেরিয়ে অনেকের মনে তিনি নীরবে দাগ কেটে বসে আছেন। ভালো থাকুন লতিফ জোয়ার্দার। নিরন্তর শুভ কামনা আপনার জন্য।