ফেলে আসা দিন গুলো – ২২

এবাদত আলী

১৯৬৮ সালের কথা। পাবনা সদর থানার হিমায়েতপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পর আমাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমার সহপাঠি বন্ধু তজিম ছিলেন সহকারি শিক্ষক। এইচ এসসি পরীক্ষায় দুজনই কৃতকার্য হই। ফলে আর বেশি দিন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয় তাই স্কুল কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে কুমারগাড়ি গ্রামের শাহজাহান আলীকে প্রধান শিক্ষক এবং বাহাদুরপুর গ্রামের সেকেন্দার আলীকে সহকারি শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আমরা আবার কলেজের অধ্যয়নে মনোনিবেশ করলাম।
আামি তখন পাবনা এডয়ার্ড কলেজে বাংলা অনার্সে প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাছাড়া এডওয়ার্ড কলেজে ছাত্র লীগের আমি একজন সক্রিয় ছাত্র নেতা। সেবারই পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বাংলা অনার্স কোর্স চালু হলো। ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা আমিসহ সুজানগরের আব্দুস সামাদ, কাশিনাথপুরের আবু বক্কর সিদ্দিক, ফরিদপুরের হাংড়াগাড়ি গ্রামের আব্দুস সাত্তার, পাবনা সদরের নলদহের আব্দুল মজিদ, নওগাঁর খুরশিদা এবং গৌরি শংকর নামে মোট ১২ জন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান স্যার এবারেই প্রথম এই কলেজে যোগদান করলেন। বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন অসিত বরন মজুমদার। অধ্যাপকদের মধ্যে হাসানুজ্জামান, খালেকুজ্জামান, আর ছিলেন অধ্যাপক ইদরিস আলী। ইদরিস স্যারের বাড়ি আটঘরিয়া থানার সোনাকান্দর।
এবছর অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে জড়িয়ে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। বিচারের নামে শুরু হলো প্রহসন। ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত করে ১১ দফা কর্মসুচি ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেই আন্দোলনে আমরাও যোগ দেই। ‘৬৯ এর ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদ। আপামর ছাত্র-জনতা বাঁধভাঙা জোয়ারের মত রাস্তায় নেমে পড়লো। ছাত্র-জনতার মুখে স্লোগানে স্লোগানে তখন সারা দেশ প্রকম্পিত। আন্দোলনের আগ্নেয়গিরিতে রুপান্তরিত সেই সময়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের মতিউর সহ অনেকে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় গুলি করা হলে পরদিন তিনি ঢাকা কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে ইন্তেক্
ঠল করেন। বিক্ষুব্ধ জনতা কয়েকজন মন্ত্রির বাড়িসহ আগরতলা মামলার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জাষ্টিস এস এ রহমানের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন অনেক ছাত্র-জনতা।
সান্ধ্য আইন জারি করা হলে ছাত্র-জনতা তা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। অগত্যা ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র্রয়ারি ছাত্র-জনতার বিজয় সুচিত হয়। আইয়ূব সরকার নিরুপায় হয়ে শেখ মুজিবসহ মিথ্যা মামলায় জড়ানো অন্যান্যদেরকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনা প্রদানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভুষিত করা হয়।
এঘটনার কয়েকদিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারিতে পাবনার সুজানগরে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ২১ ফেব্রুয়ারি সুজানগর হাই স্কুলের ছাত্ররা দশম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুস সাত্তার, নিজামুদ্দিন, আব্দুস সোবহানের নেত্রত্বে একটি মিছিল বের করেন। মিছিলটি থানার কাছে যায় এবং আব্দুস সাত্তারের সহযোগিরা থানার ইংরেজি নামফলক ভেঙ্গে ফেলে। তখন পুলিশ আব্দুস সোবহানকে আটক করে। এতে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়। এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ তখন মিছিলের উপর গুলি চালায়। পুলিশের গুলি আব্দুস সাত্তারের বাম পাঁজর
বিদ্ধ হয় এবং সকাল সোয়া দশটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। এ খবর মূহুর্তের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সেদিন কলেজ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে সোহরাব উদ্দিন সোবা, আব্দুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুলসহ কলেজ গেটে পরেশের চায়ের দোকানে অবস্থানরত অবস্থায় এই খবর পাই। কলেজের ছাত্রসহ জনতার একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। মিছিল শহর প্রদক্ষিন করে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমজাদ হোসন এমএনএ, আ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন, অধ্যক্ষ আব্দুল গনি, আ্যাড. গোলাম হাছনায়েন, আব্দুর রব বগা মিয়া, অধ্যাপক আবু সাঈদ, ওয়াজি উদ্দিন খানসহ ছাত্র-জনতা সুজানগর উপস্থিত হলে সুজানগর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ননী গোপাল সাহা, ডাঃ সলিমুল্লাহ (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ দুলালের পিত), মজির উদ্দিন মাষ্টার, ইব্রাহীম উদ্দিন বিশ্বাস, খোরশেদ আলী খোকা মৃধাসহ এলাকার অন্যান্য ব্যক্তিগন মিলে থানায় গিয়ে আব্দুস সাত্তারের লাশ নিয়ে মিছিল করেন। পরে সুজানগর স্কুল প্রাঙ্গনে রাস্তার ধারেই শহীদ আব্দুস ছাত্তারকে দাফন করা হয়। এই কবরের পাশেই পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ দুলাল, শহীদ নুরুল ইসলাম ও শহীদ আবু বকরকে কবর দেওয়া হয়। সেখানে মোট চারটি কবর এখনো এক সঙ্গে বাঁধানো আছে এবং নাম ফলক আছে। শহীদ আব্দুস সাত্তার সুজানগর হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন এবং তিনি ছাত্র লীগের কর্মী ছিলেন তাঁর পিতার নাম আছির উদ্দিন মন্ডল। তাদের গ্রামের নাম আতাইকান্দা, পাবনা সদর, পাবনা। স্বাধীনতার পরে শহীদ আব্দুস সাত্তারের নামে আতাইকান্দা গ্রামে একটি প্রথমিক বিদ্যলয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এদিকে গণ অভূত্থানে শহীদ আব্দুস সাত্তারের নামে এডওয়ার্ড কলেজের নব নির্মিত মিলনায়তনটির নাম করনের জন্য কলেজ ছাত্রদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়। আন্দোলনের মুখে কলেজ কর্তৃপক্ষ সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। নব নির্মিত অডিটরিয়ামের নামকরণ করা হয় ‘ শহীদ আব্দুস সাত্তার মিলনায়তন।’ এই মিলনায়তন উদ্বোধনের দিনের অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে আমি মোঃ এবাদত আলীও বক্তব্য রাখার সুযোগ লাভ করি। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
তাং ১৮ /০১/২০২৩