// এবাদত আলী
উপজেলা ভুমি অফিসে কানুনগো পদে চাকুরির সুবাদে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়িতে অবস্থান কালে টাংগাইলের মধুপুর গড় দেখার ইচ্ছা ক্রমেই প্রবল থেকে প্রবলতর হতে লাগল। এ প্রসঙ্গে কথা হয় আমার সুহৃদ আব্দুল হালিম, ফরিদ উদ্দিন রিয়াজী ও আব্দুল গণির সাথে। এলাকাটি তাদের পূর্ব পরিচিত। মধুপুর গড় ভ্রমনের জন্য তাই তাদেরকে সঙ্গি হিসেবে বেছে নেওয়া হলো।
নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ ইং তারিখ শুক্রবার ভোর বেলায় সরিষাবাড়ির সিমলা বাজারের পাশে অবস্থিত ভুমি অফিসের বাংলো হতে বেরিয়ে পড়লাম। শীতের শেষ। ফাগুনের প্রথম দিন। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় আনচান মন। সানক্যাপ, সান গ্লাাস, বায়োনোকুলার আর ফিল্ম ভর্তি আমার সখের ওয়াসিকা ক্যামেরা সঙ্গে নেওয়া হলো।
সরিষাবাড়ি থেকে জয়ন্তিকা পরিবহনে আব্দুল হালিমসহ দিগপাইত উপশহর বাস ষ্ট্যান্ডে পৌছে আব্দুল গণির সাক্ষাত পাওয়া গেল। আমাদের অপর সঙ্গি ফরিদ উদ্দিন রিয়াজী ছোনটিয়া বাজারে আমাদের অপেক্ষায় আছেন বলে মোবাইল ফোনে জানালেন।
বংশী নদীর পুর্ব তীরে ছোনটিয়া বাজার। সেখানে পৌছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডঃ আতিউর রহমানের চাচার ওষুধের দোকান ‘মল্লিক ফার্মেসী’তে রিয়াজীর সঙ্গে সাক্ষাত হলো।
বলতে গেলে ছোনটিয়া বাজার হতে মধুপুর গড়ের যাত্রা শুরু হলো। গোপীনাথপুর গ্রামের মাঝ দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে।একটি রিকসাা ভ্যানে আমরা চারজন রওনা হলাম। ভ্যান চালক আব্দুর রহিম ধীর গতিতে ভ্যান চালিয়ে প্রথমে এলাহি বাজার এবং পরে চাঁদপুর বাজারে গিয়ে থামলো। টাংগাইলের মধুপুর উপজেলার নাহুরিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল জুড়ে যে ইকো পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। সেই ইকো পার্ক বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য এবং চাঁদপুর রেঞ্জের রাবার উন্নয়ন প্রকল্প কমিটির অন্যতম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ওরফে বাবুল মাষ্টারের সাথে পরিচয় হলো। তিনি দুর্গম পাহাড় এবং গড় এলাকা ভ্রমন বিষয়ে বেশ কিছু ধারণা দিলেন।
চাঁদপুর বাজার থেকে পাহাড়ি উচু পথ ধরে আমরা এগিয়ে চলল¬াম। কখনো রিকসাভ্যানে আবার কখনো পায়ে হেটে রিকসা ভ্যানকে ঠেলাগাড়ি বানিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সম্মুখপানে আমাদের যাত্রা। কিছুদুর যাবার পর চাঁদপুর বিট এর ফরেষ্ট অফিস। এখান থেকেই ঘন অরন্যের সুচনা। গজারি, সোনালু, গর্জন, গামার, নিম, অর্জুন, আকাশমনি, আম, জাম, কাঁঠাল, বকাইন, চম্বল, বন্য খেজুর, ছন, বাঁশসহ বিভিন্ন ধরনের গাছে গাছে ভরপুর এলাকার এক চিলতে সরু পথ ধরে আমাদের রিকসাভ্যান এগিয়ে চললো।
মধুপুর গড় এলাকায় এখন বসন্তকাল। পাতা ঝরার সময়। গড়ে অধিকাংশ গাছপালা থেকে শুকনা পাতা ঝরছে অবিরাম। কোন কোন গাছ ইতোমধ্যেই পাতাশুন্য ডালপালা নিয়ে নব পল্লবে শোভিত হবার আকাংখায় প্রহর গুনছে যেন। কিছুদুর যাবার পর ফুলবাগ চালা পাওয়া গেল। মধুপুর গড় এলাকার ফুলবাগ চালা থেকে রাবার বাগানের শুরু। চাঁদপুর রেঞ্জের রাবার বাগানে সারিবদ্ধ রাবার গাছ। মাঝখান দিয়ে কাঁচা রাস্তা। এ রাস্তায় চলতে গিয়ে রাবার গাছ ছাড়া অন্য কোন গাছপালা এমনকি অপর কোন দৃশ্যই চোখে পড়ে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো রাবার বাগানের বিস্তীর্ণ এলাকাব্যাপি কোন জীব জন্তু কিংবা পশুপাখি নেই। কোন প্রকার প্রজাপতি কিংবা ফড়িং পর্যন্ত ডানা মেলে ওড়ে না এই এলাকায়। কোন প্রকার ফল-মুল কিংবা খাদ্য পানীয় না থাকার কারনে এ অবস্থা।
রাবার বাগানে এ সময় কাজ কম। তাই বাগানের শ্রমিকেরা গাছের ছায়ায় বসে আড্ডা জমিয়েছে। কিছু গারো উপজাতি মহিলা শুকনো পাতা সংগ্রহ করছে রাবার বাগান থেকে। অনেকেই শিশু সন্তানকে পিঠের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। কেউবা আবার শিশুকে রাখার জন্য এক গাছ হতে আরেক গাছে কাপড় বেঁধে পানি সেচের সেউতি কিংবা দোনের মত বানিয়ে তাতে শিশু সন্তানকে দোল খাওয়াচ্ছে। গারো মহিলাদের পরনে ডাবকা, (একখন্ড কাপড়) এবং গায়ে ব্লাউজ। গারো পুরুষেরা এক খন্ড কাপড় পরে মাত্র। মাথায় গামছা বাঁধা এবং গায়ে গেঞ্জি চড়ায়। অধিকাংশ গারো খালি গায়ে থাকতে পছন্দ করে। তবে নারী-পুরুষ প্রত্যেকের হাতেই একটি করে সুতীক্ষè ধারালো হাসুয়া থাকে।
আমরা সামনের দিকে যতই এগুচ্ছি ততই রাবার গাছের সারি। ডাইনে, বামে, সামনে, পিছনে সব দিকেই রাবার বাগান। রাবার বাগানের মাঝখান দিয়ে একে বেকে বয়ে গেছে বংশী নদী। দীর্ঘক্ষন পথ চলার পর রাবার বাগান পেরিয়ে আমরা তালতলা নামক স্থানে পৌছলাম। এখান থেকেই গারো উপজাতিদের মুল বসতি শুরু। ঘন বন জঙ্গলের কিয়দাংশ পরিস্কার করে গাছপালা কেটে পাহাড়ের টিলায় ঘর বাড়ী নির্মাণ করে বসতি গড়েছে তারা। প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই তারা এই গহিন অরন্যে বলতে গেলে স্বাচ্ছন্দেই জীবন যাপন করছে।
তালতলা এবং আশেপাশের বিস্তীর্ণ উচু পাহাড়ী এলাকার সমতল ভূমি ও পাহাড়ের ঢালু জমিতে প্রচুর আনারস এবং কলার চাষ করা হয়। মধুপুর গড়ের আনারস ও কলা বিখ্যাত। উচু পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নীচের সমতল ভূমি অর্থাৎ বাঈদ বা লেক এ প্রচুর ধান জন্মে। গারো মহিলারাই মুলত ধান ক্ষেতের পরিচর্যা করে থাকে। ঝর্ণার পানিতে ধানের ফলন খুব ভালো হয়। পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রায় প্রতি বছরই ধান ডুবে যায়।
এক সময় আমরা ‘থানার বাঈদ নামক’ স্থানে পৌছালাম। ওয়ার্ল্ড ভিশন নামের একটি এন,জি,ও গারো উপজাতিদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নে বৃত্তিমূলক শিক্ষাদান কেন্দ্র খুলেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে এখানে বিনামুলে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এখানে রয়েছে সেন্টপোল অনাথ আশ্রম। পাশেই সাধুপৌলের গীর্জা।
উচু পাহাড়ের দুর্গম পথ ধরে আমরা এক সময় পীরগাছায় পৌছলাম। মধুপুর উপজেলা সদর থেকে পীরগাছা পর্যন্ত গড় এলাকায় সরু পাকা সড়ক রয়েছে। পীরগাছার সেন্টপোল মিশনারী হাইস্কুল, তার পাশেই রয়েছে হস্ত শিল্পের একটি বিক্রয় কেন্দ্র। পুরুষদের সার্ট, খদ্দরের পাঞ্জাবী, খদ্দরের নকসি করা ফতুয়া এবং মেয়েদের রকমারি পোশাক পরিচ্ছদসহ বাঁশ ও বেতের কারুকার্য করা তৈজষপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে আছে এক গারো সুন্দরি যুবতি। আমরা ফতুয়া ও রুমালসহ কিছু কাপড়চোপড় কিনলাম। গাছেক নামক এক ধরনের ঝুড়িও ক্রয় করা হলো। কিছুদুর গিয়ে এক গারো রমেন্দ্রমৃ এর সাথে কথা হলো। গারো পল্ল¬ীর বাসিন্দা মৃ খুব খোলামেলাভাবে আমাদেরকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বসার জন্য চেয়ার বা বেঞ্চ নেই। ছনের ঘরের এক চিলতে বারান্দায় জরাজীর্ণ মাদুর বিছিয়ে আমাদেরকে বসতে দিলেন। রমেন্দ্রমৃ এর কাছ থেকে দোখলা পিকনিক স্পটে যাবার পথের ধারণা নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম।
চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গহিন অরন্যের মাঝে একটি বাজার পাওয়া গেল এই বাজারের নাম দোখলা বাজার। যৎসামান্য দোকানপাটসহ দুইটি খাবারের হোটেল আছে এখানে। ক্ষুধায় আমাদের অবস্থা তখন ত্রাহি মধুসুধন। তাই কোন বাছ বিচার না করে একটিতে ঢুকে পড়লাম। কোনমতে পেটে দানাপানি দিয়ে সত্বর বেরিয়ে পড়লাম। নামবিহীন হোটেলটিকে হোটেল পেরেশান বললেই বোধ হয় ভালো হতো। যাক পাশেই দোখলা রেষ্ট হাউজ ও পিকনিক স্পট। এলাকাটি অপেক্ষাকৃত উচু এবং ছিমছাম। দুর দুরান্ত থেকে আগত লোকজনের কোলাহলে মুখরিত দোখলা পাহাড়ি এলাকা।
কথায় বলে শখের তোলা আশি টাকা। আমাদের শখও যেন তেমনি। তাই দোখলা থেকে গভীর ঘন অরন্যের পথ ধরে উজানে নাহুরিয়ার দিকে রওনা দিলাম। মধুপুর গড়ের উল্লেখযোগ্য স্থান নাহুরিয়া গিয়ে চিড়িয়াখানা এবং ইকোপার্কসহ গড় এলাকার দৃশ্যাবলি অবলোকন করবো ভেবেই গহিন অরন্যের পথে যাত্রা। ঘন অরন্যের মাঝ দিয়ে পাহাড়ি পথে চলতে ভাগ্যগুনে হরিন, বনমোরগ কিংবা বানরের দেখা পাওয়া গেলে জমবে ভালো। এমনি আশা নিয়ে খালবাকলা ওঠা রাস্তা বেয়ে আমরা রিকসাভ্যানে ধীর গতিতে চলছিলাম। কিন্তু বিধিবাম। পাহাড়ী পথ ধরে তিন যুবককে আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে দেখে আমরা থামলাম। নাহুরিয়া থেকে দোখলা ফিরবার পথে বনদস্যু ওদের উপর হামলা করে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমরা কাল বিলম্ব না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে রিকসাভ্যান ঘুরিয়ে দুরু দুরু বুকে পিছু হটলাম। ভাগ্যিস যে আমরা বনদস্যুদের নাগালের মধ্যে যাইনি। আমরাও তাই যুবকদের পিছু নিয়ে দোখলা পিকনিক স্পটের দিকে ফিলে এলাম।
মধুপুর গড়ের মনোরম পাহাড়ি এলাকা ভ্রমণ করতে করতে কখন যে বিকাল হয়েছে বলতে গেলে তা কারো খেয়ালই নেই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদেরকে নিজ গন্তব্যে ফিরে যেতে হবে। একথা ভেবে সবাই যেন আঁতকে উঠলাম। রিকসাভ্যান চালক পাহাড়ের ঢালু পথে আলতোভাবে প্যাডেল ঘুরিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। সাঁঝ নামার আগেই পাহাড়ি এলাকা ত্যাগ করতে হবে- এমন তাগিদ সেও অনুভব করছে জেনে আমরা কিছুটা আশ্বস্থ হলাম। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।