— এবাদত আলী —
যাক সেকথা। ১৯৬৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের এক আদেশ বলে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ সরকারি করণ করা হয় এবং ১ মার্চ হতে তা কর্যকর হয়। এবছরই সর্বপ্রথম বাংলা অনার্স বিভাগ চালু হয়। আমি বাংলা অনার্সে ভর্তি হই। কিন্তু হঠাৎ করেই পাবনা কলেক্টরেটের অধীনে রাজস্ব বিভাগে চাকরি হওয়ায় আমি ১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। ফলে লেখা-লেখির অধ্যায় চালু থাকলেও সাংবাদিকতা করার সখ একেবারেই নি®প্রভ হয়ে যায়। এদিকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য মহান মুক্তি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। দীর্ঘ নয় মাস একটানা যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তখন মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ ঘোষণা করেন যে, যেসকল সরকারি চাকুরে মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা যে যেখানে অর্থাৎ যে থানায় অবস্থান করছেন এবং সেখানে যদি সেই বিভাগের শাখা অফিস থাকে তাহলে তারা সেখানেই যোগদান পত্র দাখিল করবেন। আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ঈশ্বরদীর ওয়াছেফ আলী কমান্ডারের অধীনে ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের পরিচালক সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জার আহ্বানে তাঁর বিশাল বাহিনীতে যোগদান করি। তাঁর অধীনস্থ একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের এ্যাসিসটেন্ট কমান্ডার ইন চিফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকি। যার কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন শাহজাদপুর পোতাজিয়ার আব্দুল মতিন মোহন মিয়া। আমাদের মুক্তিযোদ্ধার এই দলসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাগণ মিলে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর বিমান বাহিনীর সহায়তায় ১৫ ডিসেম্বর শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়িতে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে এলাকা শত্রু মুক্ত করা হয়। পরদিন মুক্তিযোদ্ধার বিভিন্ন দল শাহজাদপুরের বিভিন্ন স্কুল কলেজ এবং শাহজাদপুর ঠাকুর বাবুর কাচারি বাড়িতে(বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠি বাড়ি) ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশাসনের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকে। কমান্ডার আব্দুল মতিন মোহনের নেতৃতে আমি শাহজাদপুর কলেজ ক্যাম্পে অবস্থান করতে থাকি এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শাহজাদপুর সার্কেল অফিসার রেভিনিউ এর অফিসে যোগদান পত্র দাখিল করি। সিও রাজস্ব গোলাম কিবরিয়া আমার যেগদান পত্র গ্রহণ করেন এবং ডিসেম্বর মাসের বেতন ও ঈদের অগ্রিম বেতন প্রদান করেন।
শাহজাদপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান কালে শাহজাদপুর পারকোলা গ্রামের যুবক সাইফুদ্দিন আহমদ (পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সাইফুদ্দিন আহমদ্) ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে “গণবাংলা’’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং আমাকে উক্ত পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টা করেন। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহজাদপুর পোতাজিয়ার আব্দুল মতিন মোহন মিয়া এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা এম সি এ আব্দুর রহমান। গণবাংলা পত্রকিায় প্রকাশিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো:- একটি সংবাদের হেডলাইন ছিলো ‘দশ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ’ — গণবাহিনীর প্রতি প্রধানমন্ত্রী, গত ১৭ই জানুয়ারী ঢাকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণবাহিনীর সকল সদস্যকে আগামী দশ দিনের মধ্যে গোলাবারুদসহ মহকুমা জাতীয় ম্যালেশিয়া ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি গণবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তাদেরকে সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে যোগ্যতানুসারে ভর্তি করা হবে। তা ছাড়া যারা ইতিমধ্যেই শিক্ষা সমাপ্ত করেছেন তাদেরকে অবিলম্বে চাকুরিতে নিয়োগ করা হবে। তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস গণবাহিনীর সকল সদস্য তাঁর ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু যারা ব্যর্থ হবে তারা অপরাধী বলে বিবেচিত হবে। তাদেরকে দস্যু সংস্থার সদস্য বলে ধরা হবে। গণবাংলার ২য় সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২৩শে মাঘ’ ১৩৭৮, ৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭২। পত্রিকাটির মূল্য ২৫ পয়সা মাত্র। এই সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য সংবাদের মধ্যে ছিলো – ঈশ্বরদী- নগরবাড়ী রেল সড়ক নির্মাণ— আমাদের অর্থ ও সম্পদ না থাকলেও জনবল আছে— পাবনায় যোগাযোগ মন্ত্রী// পাবনা ২৬শে জানুয়ারী বুধবার, পাবনা পুলিশ প্যারেড ময়দানে যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব মনসুর আলী এক বিরাট জনসভায় ভাষণদানকালে বলেন, বাংলার মানুষ পৃথিবীতে এক নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানী সেনা বাহিনী মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশকে ধুলিস্মাৎ করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলো তা বাংলার মানুষ কিছুতেই হতে দেয়নি। সংগ্রামের মাধ্যমে বহু দেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যত রক্ত ক্ষয় হয়েছে অন্য কোথাও তা হয়নি। তিনি সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হলেও দেশকে গড়ে তুলবার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। উত্তরাঞ্চলের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছি। ঈশ্বরদী হতে নগরবাড়ী পর্যন্ত রেল লাইন শিঘ্রই নির্মাণ করা হবে বলে তিনি ঘোষণা দেন। তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, পুঁজিপতি পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত কলকারখানাগুলো ইত্যেমধেই জাতীয়করণ করা হয়েছে। বাকি কলকারখানার মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে হৃদয়তা গড়ে তুলবার অনুরোধ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের যদি ন্যায্য মূল্য না দেয়া হয় তাহলে মালিক পক্ষকে সরকার বরদাস্ত করবেনা। অপর দিকে শ্রমিকদেরকেও একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়ার জন্য আহবান জানান। মলিক-শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন সকলকে তাদের নৈতিক দায়িত্ব বিশেষভাবে পালন করতে হবে। আমাদের অর্থ সম্পদ না থাকলেও জনবল আছে। এই জনবলের দ্বারাই বাংলাদেশ একদিন সুখি ও সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হবে। এই বিশাল সভার সভাপত্বি করেন আব্দুর রব বগা মিয়া। জনসভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন শ্রমিক নেতা ফজলুল হক মন্টু, আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল, সোহরাব উদ্দিন সোবা, নবাব আলী ও গোলাম আলী কদেরী। সভা শেষে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। এই গণবাংলা পত্রিকাটির প্রকাশকও ছিলেন সাইফুদ্দিন চৌধুরী। শাহজাদপুর মনিরামপুর বাজার হতে প্রকাশিত হতো। আজাদ প্রেস হতে মো: নেয়ামোল মওলা খান (শাহু) কর্র্তৃক মুদ্রিত ।
এপর আমি সেখান থেকে বদলি হয়ে পাবনায় চলে আসি। পাবনা সদর মহকুমার আটঘরিয়াতে আমার পোষ্টিং হয়। আমার অফিস ছিলো দেবোত্তর সিও (ডেভ) অফিসের পাশে রূপালি ব্যাংক ও দেবোত্তর পোষ্ট অফিস সংলগ্ন। এদিকে যাতায়াতের সুবিধার জন্য পাবনা শহর থেকে ৬ মাইল দুরে অবস্থিত টেবুনিয়াতে আমি বাসা-বাড়ি নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করি এবং ফনিক্স বাই সাইকেল যোগে প্রতিদিন অফিস করতে থাকি।
আমার সহপাঠি বন্ধু আটঘরিয়ার বেরুয়ানের নজরুল ইসলাম রবি (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, ডিজি এফ আই এর সাবেক ডিজি ) এর ছোট ভাই আমিরুল ইসলাম রাঙা মাঝে মধ্যে আমার অফিসে আসতো এবং সাংবাদিকতা ও লেখা-লেখিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সাথে আলাপ আলোচনা হতো। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২সালের ৭ফেব্রুয়ারি আমিরুল ইসলাম রাঙা পাবনা থেকে সাপ্তাহিক ‘ইছামতি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতো। পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন পাবনা টেনিক্যালের ছাত্র সংসদের জিএস আব্দুল হাই তপন। পত্রিকাটি ৭/৮ সংখ্যা প্রকাশ হবার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। সে সুবাদে অফিসের কাজের ফাঁকে তার সাথে পত্র-পত্রিকা নিয়েই বেশি আলাপ হতো। (ক্রমশ:) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখঃ ২৮/০৪/২০২৫
(পুর্ব প্রকাশের পর)