ভাঙ্গুড়া (পাবনা) প্রতিনিধি ;; ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে রাজাকার হিসেবে কাজ করেন মোবারক হোসেন (মবা)। সেখান থেকে দুই সহযোগীকে সাথে নিয়ে ১৫ দিন পর তিনটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও ২০ বক্স গুলি সহ পালিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ জেলার বেসামরিক সংগঠন ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’র হয়ে তিনটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। যুদ্ধ শেষে সংগঠনের প্রধান প্রয়াত সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ মির্জা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির সনদ দিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু অবহেলায় সেই সনদটি হারিয়ে যায়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা পাওয়ার জন্য তার কোনো দপ্তরে আবেদন করা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিনমজুরের কাজ করে স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে কোনমতে চলছিল তার সংসার। কিন্তু আশির দশকের শেষের দিকে একটি দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করার পর থেকে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন যাপন করছেন মোবারক হোসেন। মোবারক হোসেনের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাথরঘাটা গ্রামে। সে ওই গ্রামের মৃত রুস্তম সরকারের ছেলে।
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৭ বছর বয়সী নিরক্ষর মোবারক হোসেন অত্যন্ত বেপরোয়া প্রকৃতির যুবক ছিলেন। এলাকার মানুষ তাকে দুর্ধর্ষ মবা বলে ডাকতো। একারণে মোবারক হোসেনকে এলাকার মানুষ ভয় পেত। এঅবস্থায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মোবারক হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান। ভারতের পশ্চিম বাংলার পলাশডাঙ্গায় সহযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রায় তিন সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে গ্রামে ফিরে আসলে পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী ও ইউপি সদস্য কটু প্রামানিক মোবারক হোসেনকে কৌশলে তৎকালীন ফরিদপুর থানায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে সহযোগিতার জন্য রাজাকার হিসেবে পাঠিয়ে দেন। পাকিস্তানি ক্যাম্পে ১৫ দিন থাকার পরে সুযোগ বুঝে মোবারক হোসেন ও তার দুই সহযোগী মিলে তিনটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও ২০ বক্স গুলি নিয়ে পালিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার বেসামরিক সংগঠন ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের’ সংগঠক প্রয়াত সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ মির্জার কাছে চলে আসেন। এরপর পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের হয়ে মোবারক হোসেন জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার ঘাটিনা রেল সেতু ও তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ বাজার সহ তিনটি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রশিক্ষণ নিতে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতে গিয়ে দুই সপ্তাহ অবস্থান করেন। সেখান থেকে ফিরে আসার কয়েক দিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিয়ে করেন মোবারক হোসেন। এরপর স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে কোনমতো সংসার চলছিল। কিন্তু আশির দশকের শেষের দিকে বাড়ির পাশে দিনমজুরের কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করায় ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিতে বাধ্য হন তিনি। বর্তমানে মোবারক হোসেনের বয়স ৭৭ বছর। বয়সের কারণে চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, শ্বাসকষ্ট সহ নানাবিধ শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না মোবারক হোসেন। তাই গ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় শুধুমাত্র নগদ টাকা ভিক্ষা করে স্ত্রী ও তার ভরণপোষণ চালান। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় পলাশডাঙ্গা যুব শিবির এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক সংগঠন ছিল।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোবারক আলী বলেন, পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে রাইফেল ও গুলি নিয়ে পালিয়ে আসলে আব্দুল লতিফ মির্জা আমাকে বুকে ধরে আলিঙ্গন করে। সেদিনের কথা আমি ভুলতে পারিনা। যুদ্ধের স্মরণীয় মুহূর্ত নিয়ে তিনি বলেন, নওগাঁ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ওই যুদ্ধে ৪৫ টি নৌকা নিয়ে পাকিস্তানের প্রায় তিন শতাধিক সৈন্য নওগাঁ বাজার আক্রমণ করেছিল। পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি সেনারা পরদিন আবারও নওগাঁ বাজারে এসে হামলা চালায়। প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে মুক্তিবাহিনীর গুলি ফুরিয়ে গেলে আমরা সরে যেতে বাধ্য হই। এদিন অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পাই আমি সহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। সেখান থেকে পালিয়ে আমরা কয়েকজন ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের পরমানন্দপুর গ্রামে হদু হাজির বাড়িতে আশ্রয় নেই। এরপর পুরো নওগাঁ বাজার এলাকা পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। দেশ স্বাধীনতার পরে আব্দুল লতিফ মির্জা আমাকে সনদ দিয়েছিল। কিন্তু আমার মা ঘর পরিষ্কার করার সময় সনদটি হারিয়ে ফেলে। তাই আর ভাতার জন্য কোথাও আবেদন করতে পারিনি।
জীবন যাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্থাভাবে দিন কাটাই। এর উপর গ্রামের একটি বাড়িতে কাজের সময় দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেলে কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। পরে মানুষের কাছে হাত পেতে ও ধার-কর্জ করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পঙ্গুত্বের পর থেকেই নিজের ও স্ত্রীর খাবার জোগাড় করতে ভিক্ষা করতে হয়। এখন চেয়ারম্যানের দেেয়া বয়স্ক ভাতা ও ভিক্ষা করে জীবন চালাই। তবে বয়সের ভারে ভিক্ষা করতেও কষ্ট হয়।
মোবারক
হোসেনের প্রতিবেশী পারভাঙ্গুড়া ইউপি চেয়ারম্যান হেদায়েতুল হক বলেন,
গ্রামের প্রবীণ মানুষদের কাছে শুনেছি মোবারক হোসেন খুব সাহসী যুবক ছিলেন।
সে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে রাইফেল ও গুলি নিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে
অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সময় এটি গ্রামের সকল বয়স্ক মানুষ সবাই দেখেছে।
সরকারি বিভিন্ন দপ্তর বিষয়টি নিশ্চিত হতে খোঁজখবর নিচ্ছে। তবে এখনো কোন
প্রকার সহযোগিতা পায়নি। তাই তাকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা
করা হয়।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মোকসেদ আলী বলেন, ভাঙ্গুড়ার
অনেকেই সিরাজগঞ্জ জেলার বেসামরিক সংগঠন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের হয়ে
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে তাদের সকলের নাম ও পরিচয় ভাঙ্গুড়া
উপজেলা কমান্ড কাউন্সিলের কাছে নেই। তাছাড়া অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। তাই মোবারক
হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকলেও আমাদের জানা নেই।
মোবারক
হোসেনের বিষয়ে ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশরাফুজ্জামান
বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক মানুষ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
তাই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মানবেতর জীবন-যাপন খুবই কষ্টদায়ক। বিষয়টি
খোঁজখবর নিয়ে মোবারক হোসেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হলে সরকারি সহযোগিতা
পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
ফটো ক্যাপশন: নিজের জন্মভূমি পাথরঘাটা গ্রামে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মোবারক হোসেন।