দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এলো হেমন্ত কাল। ছয় ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্ত কার্তিক ও অগ্রহায়ন মাস নিয়ে গঠিত। কালের পরিক্রমায় হেমন্তের রূপ ও দান আমাদের মুগ্ধ করেই যায়। হেমন্তের ফসলের মাঠ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। যুগ যুগ ধরে হেমন্তের হলুদ বরণ পাকা ধান আমাদের হৃদয়কে করে আলোড়িত। কৃষকেরা মাঠে ধান কাটেন। আঁটি বেঁধে ক্ষেতেই শুকাতে দেন। কোথাও চলে ধান মাড়াইয়ের পালা। গাঁয়ের বধুরা ব্যস্ত থাকেন ধান ঘরে তোলার কাজে। চাকা নির্ভর এক শ্রেণীর মানুষ গরু, মহিষ, ঘোড়ার গাড়িতে, লসিমন, করিমন, ভ্যান যোগে মাঠ থেকে কৃষকের ধান বয়ে বাড়িতে পৌছে দেবার কাজ করেন। তারা ও অপেক্ষায় থাকেন হেমন্ত আসার। এ কাজ করে তারাও আয় করেন অর্থ। শুধু তাই নয় ধান কুড়াণীরা হেমন্তকে বরণ করেন সাদরে। কেননা, এসময় মাঠে মাঠে ধান কুড়িয়ে তারা ব্যবস্থা করেন কয়েক মাসের অন্নের। হেমন্তের ঐতিহ্যবাহী নবান্নকে ঘীড়ে আমাদের উৎসাহ মনে যোগ করে ভাল লাগার অন্যরকম আমেজ। হেমন্তের চাঁদ, তারা ভরা রাতের সৈন্দর্য আমাদের যেমন মুগ্ধ করে তেমনি মুগ্ধ করে ভোড় বেলার শিশির সিক্ত দূর্বা ঘাস ও ধানের শীষ।
বিকেল বেলা গাছিড়া মাজায় হাড়ি বেঁধে খেজুর গাছে ওঠেন গাছে রসের হাড়ি বাঁধতে। কুয়াশা ভেজা সকালে রস সংগ্রহে আবার উঠে পরেন সেই খেজুর গাছে। রস জাল দিয়ে সাচে ঢেলে তৈরী করেন নানান আকৃতির মিষ্টি পাটালী গুড়। এসব গুড় দিয়ে তৈরী পিঠে পায়েশ হালকা শীতের পরশে হয়ে ওঠে আমাদের মনোরঞ্জন ও রসনা বিলাসের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। গ্রামের বৌঝিরা শ^শুর বাড়ির ধান তোলার কাজ শেষে জামাইসহ পিত্রালয়ে “নাইওরে” আসেন। হেমন্তে খাল বিল জলাশয়ের পানি কমে যায়। এসময় জেলে দের পাশাপাশি মাছ শিকারে ব্যস্ত হন সৌখিন মাছ শিকারীরা। পলো দিয়ে মাছ ধরতে নিকট ও দূরের বিভিন্ন জলাশয়ে ছুটে যান তারা। বড় মাছের পাশাপাশি ছোট মাছও বেশি ধরা পরে এসময়। দেশি কই, পুটি মাছ ভাজার গন্ধ বাড়ির আঙিনা ছাপিয়ে ছড়িয়ে পরে হেমন্তের বাতাসে। এসময় বেশি মাছ ধরা পরায় মৎসজীবিরা উদ্বৃত্ত মাছ শুটকি করেন। ভোজন রসিকরাও মাছ শুকাতে ভোলেন না। ধনে পাতা সহযোগে টেংড়া, টাকি, পুটি, বোয়ালসহ অন্যান্য শুটকী মাছ রান্না হয় নতুন গাছের কাটাওয়ালা বেগুন, ফুল কপি দিয়ে। শুটকি ব্যবসায়ীরা শুটকির চাতালে শুটকী করেন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। শুটকির গন্ধ ছড়িয়ে পরে বাতাসে। মাছ ধরা, খাওয়া ও শুকানোর আনন্দ হেমন্তের ভাল লাগায় যোগ করে বাড়তি মাত্রা। এসময় খাল বিলে আসতে শুরু করে নানান রঙের অতিথি পাখি। অতিথি পাখিরা বিল ঝিল খাল জলাশয় গুলোকে করে তোলে মনোমুগ্ধকর। রসনা বিলাসের অন্যতম উপকরণ কুমড়ো বড়িও বেশি তৈরী হয় হেমন্ততেই। শহরের মোড়ে মোড়ে ভাপা চিতই পিঠা বিক্রি শুরু হয় এই হেমন্ত কালেই।
আপন বিচিত্রতা, রূপ, রসে হেমন্ত যে পরিপূর্ণ তার প্রমান মেলে প্রখ্যাত কবি লেখকের লেখনীতে। বিখ্যাত কবি সুফিয়া কামাল তার হেমন্ত কবিতায় লিখেছেন, সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/ কোন পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে। আবার, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে হেমন্তকে নিয়ে লিখেছেন, হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে, হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে। ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে। ঋতুর রানী হেমন্তের হলুদ গাঁদা, গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলী, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বক ফুল আমাদের মুগ্ধ করেই ছাড়ে। এসময় টায় মানুষ আর প্রকৃতি মিশে যেন একাকার হয়ে যায়। হেমন্তের শান্ত প্রকৃতি, ফুল, ফল, ফসলকে ফিরে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামি পাঁচটি ঋতু। শুভ বিদায় হেমন্ত। শুভ বিদায় ঋতুর রানী।