আমার রাজনৈতিক জীবনে মরহুম ওয়াজিউদ্দিন খান (উদ্দিন ভাই) এবং মরহুম আবুল ফজল খান (হাজী সাহেব) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন, তাঁদের সাথের স্মৃতিগুলি লিখে শেষ করা যাবে না, আজকের পর্বে উদ্দিন ভাইয়ের সাথের কিছু স্মৃতি আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম I
মন্ত্রিত্বের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান:
খুব সম্ভবত: ১৯৮৭ সালের কথা, উদ্দিন ভাইকে এরশাদ সরকার শ্রমিক আন্দোলনের কারণে সেই সময় একবার গ্রেফতার করেছিল, পরিবহন শ্রমিকরা সারা দেশে গাড়ী চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সারা দেশ অচল করে দিয়েছিলো, শেষ পর্যন্ত সরকার উদ্দিন ভাইকে ছেড়ে দিবে বাধ্য হয়েছিল I এরশাদ সরকার অনুধাবন করতে পেরেছিলো যে সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠন একটি ফ্যাক্টর, উদ্দিন ভাইয়ের জনপ্রিয়তা দেশ ব্যাপী তুঙ্গে তখন, ঠিক সেই সময়কালে কোনো একদিন অনেকের সাথে আমিও উদ্দিন ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করছিলাম, উদ্দিন ভাইয়ের বাসায় একটি লাল টেলিফোন ছিল তিনি সেই টেলিফোন রিসিভ করে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে আমাদের কাছে এসে বললেন যে তাকে যোগাযোগ মন্ত্রী হবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে সরকার এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বেবী ইসলামকে মন্ত্রিত্ব দেবার প্রস্তাব করেছেন I
ভুলবশত: জনগণ দ্বারা আক্রান্ত :
১৯৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় দিন রাত আমরা জনগণের মাঝে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতাম I সেদিন হাদল ইউনিয়নে ত্রাণ কাজ শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো I শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকায় হাদল থেকে আমরা বনওয়ারী নগর রওয়ানা হলাম, বড়বিল দিয়ে খাগড়বাড়ীয়া গ্রামের কাছে আসতেই শত শত নৌকায় শত শত মানুষ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেললো ডাকাত ভেবে I অন্ধকারে আমাদের দেখা যাচ্ছিলো না, জুৎ কুঁচ হলেঙ্গা লাঠি ফালা হাতে শতশত জনগণ ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের অনেকটা কাছে চলে আসলো, উদ্দিন ভাই নৌকা থামিয়ে দিলেন I পাশেই রুলদহ গ্রাম, সেই গ্রামের মাইকে ডাকাত ধরার জন্য মাইকিং করা হচ্ছিলো, আমি আসাদ রাজ্জাক জোরে জোরে চিল্লায়ে বলছিলাম যে উদ্দিন ভাইয়ের নৌকা, কিন্তু কেউ তা কর্ণপাত না করে দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র তাকে করে এগিয়ে আসছে আমাদের নৌকার দিকে, ইতিমধ্যেই কিছু ইটের ঢিলা এসে আমাদের নৌকার আসে পাশে পরতে শুরু করেছে, উদ্দিন ভাইয়ের কাছে একটা পিস্তল ছিল, উদ্দিন ভাইয়ের অনুমতি চাইলাম ফাঁকা গুলি করার জন্য, উদ্দিন ভাই অনুমতি না দিয়ে মাঝিকে বললেন যে হারিকেন থাকলে শীঘ্রই জ্বালিয়ে দিতে, মাঝিরা হারিকেন জ্বালিয়ে দিলে উদ্দিন ভাই ছৈয়ের উপরে উঠে নিজের মুখের কাছে হারিকেন ধরলেন, ‘বলতে লাগলেন আমি উদ্দিন, আপনাদের এমপি’ খলিল ভাইয়ের শশুর মরহুম রোস্তম হাজী সাহেবর কাছে সম্ভবত একটি পাওয়ারফুল টর্চ লাইট ছিল, সেই টর্চ লাইটের আলো উদ্দিন ভাইয়ের মুখে পড়তেই তিনি উদ্দিন ভাইকে চিনে ফেললেন, এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন যে ‘ডাকাত নয় আমাদের এমপি সাহেব’ I
ইতিমধ্যেই বনওয়ারী নগর সদরে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে আমাদেরকে ডাকাত আক্রমণ করেছে, সর্বশ্রেণীর হাজার হাজার নারী পুরুষ যার যা ছিল তাই নিয়ে রওনা হয়েছিল আমাদের উদ্ধারের জন্য, মরহুম রতন চাচা তিনি বাড়ী থেকে বন্দুক নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন আমাদের উদ্ধারের জন্য I পরিশেষে খাগড়বাড়ীয়া গ্রামের লোকজন নিজেরাই আমাদেরকে নিয়ে বনোয়ারীনগর পৌঁছে দিয়ে গেলো I উদ্দিন ভাইয়ের সারা শরীর ঘেমে সাদা পাঞ্জাবি এবং ভিজে গিয়েছিলো, ভুল বোঝাবুঝির কারণে একটি মারাত্মক অনাকাঙ্কিত দুর্ঘটনার হাত থেকে আমরা সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম I
ছুটির দিনে জামিন ব্যবস্থা:
যে কোনো ছুতায় তৎকালীন সরকারী দল আমাকে প্রায়ই এক নাম্বার আসামী করে মামলা দিয়ে অহরহ হয়রানি করতো I এমনই একটি মামলা আমাদের বিরুদ্ধে হয়েছে জেনে উদ্দিন ভাই পাবনা থেকে বনওয়ারী নগর আসলেন, উপজেলা আদালত তখন চালু থাকলেও সরকারী ছুটির দিন ছিল সেদিন, উদ্দিন ভাই ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ইউ, এন, ও সাহেবকে আমাদের জামিন দেবার জন্য বললেন, তৎকালীন ইউ,এন,ও সাহেব ছুটির দিনের জন্য আপত্তি করছিলেন I সেদিন দেখলাম উদ্দিন ভাইয়ের হুংকার, তিনি হুংকার দিয়ে আজকেই জামিন দেবার জন্য বললেন, ইউএনও সাহেব অনেকটা হতভম্ব হয়ে সবাইকে নিয়ে তার অফিসে আসতে বললেন, আমি সবাইকে ইউএনওর অফিসে আসতে বললাম, প্রায় ৪০ জন আসামী যার মধ্যে অর্ধেক উপস্থিত হলো, ইউ,এন,ও সাহেব সবাই আছে কি না তা জানবার চেষ্টা না করেই অফিসের বারান্দায় বসে কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই সবার জামিন মঞ্জুর করে দিলেন I
আরও কিছু স্মৃতি :
বিএনপি ফরিদপুর উপজেলার সভাপতি মরহুম আবুল মাস্টার কোনও এক কারণে জেলে গিয়েছিলেন, উদ্দিন ভাই অবগত হবার পরে একদিন রাতে তিনি আমাদের সাথে করে মরহুম আবুল চাচার বাড়ীতে গেলেন এবং তার পরিবারকে সাহায্য সহানুভূতি করে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আসলেন ই
উত্তর টিয়ারপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার ভাই তৎকালীন বিএনপির বলিষ্ঠ নেতা ছিলেন, তিনি বনওয়ারী নগর হাইস্কুলের পূর্বপাশের পুকুরে মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন I একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তি তৎকালীন মৎস মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে সাত্তার ভাইয়ের লিজ বাতিল করে নিজ নামে তা বরাদ্দ করে নিয়েছিলেন, মন্ত্রীর সুপারিশ উপেক্ষা করে উদ্দিন ভাই কিভাবে সাত্তার ভাইয়ের নামে আবার লিজ করে দিয়েছিলেন তিনি ফিরে এসে আমাদের কাছে যা বললেন তা ছিলো নিম্নরূপ: সাত্তার ভাই অসহায় হয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে ঢাকায় গিয়ে উদ্দিন ভাইয়ের শরণাপন্ন হলেন, উদ্দিন ভাই জেলা মৎস কর্মকর্তাকে ফোন করে লিজ পাল্টিয়ে সাত্তার ভাইয়ের নামে লিজ কাটার জন্য বললেন, মৎস কর্মকর্তা মন্ত্রীর সুপারিশ এবং নির্দেশের কথা উল্লেখ করতেই উদ্দিন ভাই হুংকার দিয়ে মৎস কর্মকর্তাকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে মন্ত্রীর সুপারিশের লিজ বাতিল করে সাত্তার ভাইয়ের নামে লিজ ইস্যু করার জন্য সময় দিলেন এবং এটাও টেলিফোনে বলে দিলেন যে পাবনার মন্ত্রী তিনি, মন্ত্রী কিছু বললে তাকে জানিয়ে দিবেন I
ফরিদপুর উপজেলা কৃষক লীগের বর্তমান সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন একটি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে উদ্দিন ভাইকে দিয়েছিলেন যা উপজেলা প্রশাসন দ্বারা সম্ভব ছিল না রাজনৈতিক কারণে I উদ্দিন ভাই মাহতাবের কাছে থেকে প্রকল্পটি নিয়ে ঢাকা চলে গেলেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তৎকালীন জাতীয় পার্টির প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর স্বাক্ষর করা অনুমোদনকৃত প্রকল্পটি ফরিদপুরের প্ৰশাসনের কাছে চলে এলো এবং প্রশাসন মাহতাবের তত্ত্বাবধায়ন কাজটি করতে বাধ্য হয়েছিল I
উদ্দিন ভাইয়ের একটি স্বপ্ন ছিল যে চাটমোহরে একটি বাড়ী কিনবেন এবং ফরিদপুর থেকে একটি গাভী ক্রয় করে সেই বাড়ীতে লালন পালন করবেন, হয়তো তার ইচ্ছা ছিল যে এভাবেই পাবনা ৩ আসনে স্থায়ী হয়ে সুখে দুঃখে পাবনা তিনের জনগণের সাথে একেবারেই মিশে যাবেন I
কিন্তু আমরা অদূৰদৰ্শিতাবশতঃ বিদেশী তকমা লাগিয়ে সহজেই ‘উদ্দিন ভাই খেদাও’ আন্দোলন গড়ে তুলে এই মহান ব্যাক্তিকে পাবনা ৩ আসন থেকে নির্মমভাবে বিদায় করেছিলাম I ‘উদ্দিন ভাই খেদাও’ আন্দোলনের অন্তরালে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামীলীগ খেদানোর আন্দোলন করেছিলাম আমরা তা তখন না বুঝলেও যা আজ দ্রুবতারার মতো পরিস্ফুটিত I
উদ্দিন ভাইকে পাবনা ৩ আসন থেকে তাড়িয়ে দিলেও তিনি পাবনা ৩ আসনের জনগণকে মন থেকে কখনও বিদায় করেন নাই, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাবনা ৩ আসনের মানুষের খোঁজ খবর রাখতেন, পাবনা তিনের যে কোনো ব্যাক্তির জন্য তার বাড়ীর দরজা খোলা ছিল, যে কোনো ব্যাক্তির আমন্ত্রণে শরীর না পারলেও স্বপরিবারে হাঁসিখুশি মনে চলে আসতেন যেন তিনি নিজের বাড়িতেই ফিরছেন, হয়তো পাবনা ফিরে যাবার সময় মনে অনেক কষ্ট পেতেন এই মহান ব্যাক্তিটি I
মৃত্যুর বছর খানেক আগে তার বাসায় গিয়ে বুঝতে পারছিলাম যে হয়তো এটাই শেষ দেখা তাঁর সাথে আমার, বিছানা থেকে কোলে করে তুলে বসিয়ে নিজে হাতে ফল খাইয়ে দিচ্ছিলাম তাঁকে, তিনি স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছিলেন না, কিন্তু একটি অস্পষ্ট কথা আজও স্পষ্টভাবে হৃদয়ে গেঁথে আছে, তিনি বলছিলেন তোরা আমাকে বিদায় করতে পারলি ? আমি কি অপরাধ করেছিলাম ? এখন ভালো আছিস তোরা ? চোখের জলে তাঁর কথাগুলির উত্তর বয়ে চলছিল অবিরাম I
সৃষ্টিকর্তা এই মহানব্যাক্তিকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, আমিন I
খুব শীঘ্রই: ভাঙ্গুড়া উপজেলা উৎপত্তির গোড়াপত্তন I