বিএনপি আমলে এক নেতার সুপারিশে চাকরি পান প্রদীপ, বিএনপি পরিবারের সন্তান হয়েও আওয়ামী লীগ আমলে চাকরি পান লিয়াকত
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই টেকনাফ থানার প্রত্যাহারকৃত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশেই খুন হয়েছেন সিনহা মো. রাশেদ খান। তার নির্দেশ পেয়ে শামলাপুর চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। প্রদীপ-লিয়াকত দুই জনই একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
বিএনপি সরকারের সময় ১৯৯৫ সালে তত্কালীন এক নেতার সুপারিশে চাকরি হয় প্রদীপের। আর বিএনপি পরিবারের সন্তান হয়েও আওয়ামী লীগের আমলে এক এমপির সুপারিশে চাকরি পান লিয়াকত। লিয়াকতের ভাই ছাত্রদলের নেতা। তার পরিবার বিএনপি করে। এমন তথ্য বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। প্রদীপ-লিয়াকতের মতো বিএনপি পরিবারের সন্তান পুলিশে আরো অনেক আছে, যারা সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ঘাপটি মেরে থেকে সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। প্রদীপ বর্তমান সরকারের ১২ বছর ধরেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের সর্বত্র। পেশাগত দাপট দেখিয়ে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দেশে-বিদেশে তার অঢেল সম্পদ।
আমাদের পটিয়া (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রদীপ-লিয়াকতের বিভিন্ন অপকর্মের তথ্য পেয়েছেন। ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় রয়েছে। প্রদীপের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সরোয়াতলী গ্রামে এবং পরিদর্শক লিয়াকতের বাড়ি পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব হুলাইন গ্রামে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওসি প্রদীপের নামে চট্টগ্রাম শহরে একাধিক ভবন, স্ত্রীর নামে লক্ষ্মীকুঞ্জ নামে ভবন রয়েছে। তাছাড়া গ্রামের বাড়িতে বিশাল দিঘিতে মাছ চাষ করা হয়। এসবের দেখাশোনা করেন ওসি প্রদীপের ভাই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সাবেক হেডক্লার্ক দিলীপ দাশ। একইভাবে পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নামে-বেনামে গ্রামে ও শহরে সম্পদ রয়েছে। ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের ঘটনায় পটিয়া ও বোয়ালখালীর লোকজন ক্ষুব্ধ। এ দুই জনের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সরোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর কুঞ্জরী গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত হরেন্দ্র লাল দাশের পুত্র প্রদীপ দাশ। প্রদীপের পিতার দুই সংসারে পাঁচ ছেলে ও ছয় মেয়ে রয়েছে। প্রদীপ ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। তাদের পৈতৃক একটি সেমিপাকা ঘর ও একটি দোতলা পাকা ভবন রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে প্রদীপের স্ত্রীর নামে বড় আকারের (৪ একর) দিঘি রয়েছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা এলাকায় স্ত্রীর নামে লক্ষ্মীকুঞ্জ নামের পাঁচতলা একটি ভবন রয়েছে। স্ত্রীর নামে-বেনামে প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ছাড়াও বিদেশেও সম্পদ রয়েছে বলে গ্রামবাসী জানান।
প্রদীপের গ্রামের লোকজন জানিয়েছেন, প্রদীপ পুলিশের চাকরি নেওয়ার পর কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অথচ চাকরিতে যোগদানের আগে তার পৈতৃক তেমন কিছুই ছিল না। প্রদীপ গ্রামবাসীকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে অনেক অপকর্ম করেছেন।
উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের পূর্ব হুলাইন গ্রামের মৃত মো. সাহাব মিয়ার ছেলে লিয়াকত ২০১০ সালে পুলিশে যোগদান করেন। তার পরিবার বিএনপির সঙ্গে জড়িত এই তথ্য গোপন করে লিয়াকত এক এমপির সুপারিশে চাকরি পান। তিনি হাবিলাসদ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, হুলাইন ছালেহ নূর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাশ করেন। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে লিয়াকত পঞ্চম। তার ভাই মো. শওকত বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
পটিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম শিরু লিয়াকত আলীর চাকরির জন্য ঐ এমপিকে সুপারিশের জন্য অনুরোধ করেন। এর পর লিয়াকতের চাকরি হয়। তিনি প্রথমে ডিবি, পরে সোয়াত ও অ্যান্টি টেরোরিজম টিমে কাজ করেন। দুই বছর আগে পুলিশ পরিদর্শক পদোন্নতি পান। এক বছর আগে তিনি টেকনাফ থানায় যোগদান করেন। ভাই আবু তাহের বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
বিএনপির অনুসারী ভাই শওকত রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার অধীনে খাদ্য সরবরাহের কাজ করেন। অপর ভাই হায়দার আলী বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। লিয়াকতের মা কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার ছেলের কী ফাঁসি হবে? লিয়াকত গ্রেফতারের পর থেকে তার মা একেবারে ভেঙে পড়েছেন। লিয়াকত চন্দনাইশে প্রথম বিয়ে করেন। পরবর্তীতে তাদের বিচ্ছেদ হয়। পরে বোয়ালখালীতে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বর্তমানে তার একটি দুই বছরের ছেলে সন্তান রয়েছে। পটিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম শিরু বলেন, পুলিশের চাকরি পেতে লিয়াকত আলী সহযোগিতা চান। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এক এমপির সুপারিশে লিয়াকত আলীর চাকরি হয়। তবে চাকরি পাওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
লিয়াকতের বাড়ি এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার নুরুল ইসলাম জানান, লিয়াকত লেখাপড়ায় মেধাবী ছিল। তবে পুলিশের চাকরিতে যোগদানের পর এলাকায় কোনো অবৈধ আচরণ দেখিনি। তবে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিচার হওয়া দরকার।
উল্লেখ্য, ৩১ জুলাই কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় একটি চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। মেজরের ওপর প্রথম গুলি চালান পটিয়ার লিয়াকত আলী।