বাংলা ১৩০২ সনের ২৬ চৈত্র বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গ মাতা’ কবিতায় লিখেছিলেন,‘‘ সাত কোটি সন্তানেরে, / হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছো বাঙালি করে /মানুষ করনি।’’ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলার মাটিতে প্রত্যাবর্তন করলেন। রমনা রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তখন জনস্রোতে কানায় কানায় পূর্ণ । জাতির পিতা বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিব তখন জনতার উদ্দেশ্যে বলেন “ আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন । আমার সারা জীবনের আশা আকাংখ্যা পরিপূর্ণ । ” তিনি আবেগ আপ্লুুত কন্ঠে বলেন “ রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বলেছিলেন সাতকোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি । মুজিব বলেন এটি চিরন্তন সত্য নয় । বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বকে প্রমাণ করে দিয়েছে তারা বীরের জাতি।’’
বঙ্গবন্ধুর চিরন্তন এই উক্তিই প্রমাণ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি বীর সেনানীদের কথা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি এক মন এক প্রাণে মাতৃভুমি রক্ষার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ভারতের প্রখ্যাত গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার (যার জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর, পাবনার ফরিদপুর থানার গোপাল নগর গ্রামে), সেসময় অনুপ্রেরণা সঙ্গীতে বলেছিলেন,‘‘ তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।/ মাগো ভাবনা কেনো,/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে-/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি,/ আমরা পাঁজর দিয়ে দুর্গ ঘাটি গড়তে জানি।’’
সত্যি কথা বলতে কি? কোভিড নাইনটিন ওয়ার বা করোনা যুদ্ধে বাঙালি যোদ্ধাদের পাঁজরের দুর্গ ঘাটিতেই আঘাত হেনেছে করোনাভাইরাস। এপর্যন্ত কেরোনা ৩ হাজার ৪৭১ জনকে মৃত্যুর শীতল কোলে চড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সকল অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট যোদ্ধা মিলেও তাকে কোন মতেই কাবু করতে পারছেনা। এই করোনা ভাইরাস এমন সময় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে যখন স্বাধীন বাংলার স্থপতি বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে কমবেশি সকেেলই ব্যস্ত। সৌভাগ্যবশত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এসময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান যে ভিন্ন মাত্রায় যোগ হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিলোন। দেশি-বিদেশি অতিথিদের আনাগোনায় অনুষ্ঠানের ধাঁচ-ধরণ ব্যতিক্রমধর্মী করার প্রস্তুতি চলছিলো। পাশাপাশি পরের বছর অর্থ্যাৎ ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পুর্তি অনুষ্ঠানও জাকজমকের সাথে পালন করার তোড়জোড় চলছিলো।
কিন্তু কি করতে কি হয়ে গেলো। কোভিড নাইনটিন বা করোনা যুদ্ধের কবলে সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেলো। গত বছরের শেষ দিকে পরাক্রমশালী দেশ চীনে কোভিড নাইনটিন সোলজার প্রথম আক্রমণ করে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর হতে উৎপত্তি হয়ে তা ক্রমান্বয়ে বিশে^র অন্যন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অদৃশ্য শত্রু এই করোনাভাইরাস যাতে কোনভাাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার সরকার এর ওপর কড়া নজরদারি করছিলো। কিন্তু এত শতর্কতার ভেতর দিয়ে করোনা সোলজার বাংলাদেশে কিভাবে প্রবেশ করলো তা ভাবতেই অবাক লাগে।
স্পার্টার রাজা মেনেলাস ও তার ভাই আগামেনন বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে ট্রয় নগরীর রাজপুত্র প্যারিসের বিরুদ্ধে হেলেনকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে। ট্রয় নগরী আক্রমণ করে দশ বছর ধরে যুদ্ধ করে জয়লাভে ব্যর্থ হয়। পরে তারা এক চাতুরির আশ্রয় নেয়। তারা সবার অজান্তে বিশাল আকৃতির একটি কাঠের ঘোড়া এনে ট্রয় নগরির সম্মুখে রেখে দেয়। ট্রয় নগরির মানুষজন মনে করলো স্পাটানরা যুদ্ধে হার মেনে নিয়েছে আর তাদের জন্য উপহার হিসেবে এই ঘোড়া রেখে গেছে। তারা কিছু না বুঝে নগরের সুউচ্চ গেইট পার করে এই ঘোড়াটিকে ট্রয় নগরির ভেতরে নিয়ে গেলো। আর এটাই ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। মাঝরাতে যখন ট্রয়ের বাসিন্দারা ঘুমিয়ে পড়ে- তখন কাঠের ঘোড়া খুলে যায়। আর ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সৈন্যরা বেরিয়ে আসে। তারপর যা ঘটার তাই ঘটে।
আমাদের বেলায়ও তেমনি একটা ভুল হয়েছে। আগে থেকে যদি করোনাভাইরাসের প্রবেশের উপর অধিক কড়াকড়ি আরোপ করা হতো। যদি বিমান পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো তাহলে আর করোনা সোলজাররা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারতো না। চীনের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভুটান আজো করোনাভাইরাসের প্রভাব বিস্তারে বাধা হয়ে রয়েছে। সেখানে করোনা আঘাত করলেও এপর্যন্ত আক্রান্ত ১০৮ জনের বেশি ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে সমর্থ হয়নি। তন্মধ্যে সুস্থ্য হয়েছেন ৯৬ জন। বাদ বাকি কয়েকজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সব চেয়ে বড় কথা এপর্যন্ত সেখানে কেউ করোনাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেনি। কারণ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং নিজেই একজন ডাক্তার। যিনি ১৯৯১ সালের নভেম্বরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হয়ে এসেছিলেন। এরপর এমবিবিএস পাশ করে জেনারেল সার্জারি নিয়ে লোটে শেরিং এফসিপিএস করেছিলেন ঢাকাতেই। তিনি ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে কিছু দিন হাতে কলমে কাজও করেছেন। বলতে গেলে করোনা সেখানে পরাস্থ। বিশে^ এমন আরো ১৪টি দেশ রয়েছে যেখানে করোনা সোলজাররা প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি।
আমাদের দেশে গত ৮ মার্চ প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস তিনজন ইতালি ফেরত যাত্রীদের সাথে মিতালী করে অর্থাৎ তাদেরকে আক্রান্ত করে। এদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারি। তাদের ঝোলায় যে করোনা ঢুকেছে তা তারা বুঝে উঠতে পারেনা। বিমানের আরামদায়ক সিটে বসে তাদের সাথে সাথেই হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে করোনা। এরপর বিনা বাধায় বাংলার মাটি স্পর্শ করে বিমান বন্দর ত্যাগ করলেও তা কারো নজরে আসোনা। পরে তাদের দেহ তল্লাসি করলে অর্থাৎ তাদের দেহ পরীক্ষা করার পর করোনা সোলজারের খবর রটে যায়।
রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, শক্তিশালী করোনাভাইরাসের নিজের পায়ে চলার মত কোন চালিকা শক্তি নেই। আলোক লতা যেমন যেকোন তরতাজা গাছের ওপর ভর করে সেই গাছকে অবলম্বন করে জীবন ধারণ করে, করোনাভাইরাসও যেন তাই। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির হাচি-কাশি, কফ-থুতু কিংবা তার সংসম্পর্শে এলেই কেবল নাক, মুখ ও চোখের ভেতর দিয়ে সে সুস্থ্য ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়। তা না হলে দিন-রাত হা পিত্তেস করেও সে কোন ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়না। তাইতো রোগ বিশেষজ্ঞগণ মুখে মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বার বার সাবান পানি দিয়ে দুহাত ২০ সেকেন্ড সময় ধরে ধৌত করা কিংবা বার বার হ্যান্ড সেনিটাইজার ব্যবহারের কথা বলে আসছেন।
সব চেয়ে ভালো হয় করোনাকালে ঘরের বাইরে বের না হওয়া। যদি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতেই হয় তাহলে অবশ্য অবশ্যই সামাজিক দুরত্ব বা শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে হবে। যদি কোন সময় রোগাক্রান্ত ব্যক্তির নিকট যেতে হয় তাহলে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই ব্যবহার করতে হবে।
আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজের ও পরিবারের সদস্যদেরকে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বুহ্য রচনা করতে পারি তাহলে করোনা মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবো। ফলে হাসপাতালে কোভিড নাইনটিন রোগির প্রবাহ কমে যাবে। এতে করে করোনা নির্মুলে নিয়োজিত সৈনিকদেরকে রাজ কোষ থেকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে আর হিমশিম খেতে হবেনা। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানাকেও আর প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় কষ্ট করে অনলাইনে স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রচার করতে হবেনা। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।