করোনা কালের জীবন ধারা (পূর্ব প্রকাশের পর ) (৫৫)

কোভিড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে বাংলাদেশেও ডাক্তার, নার্সসহ কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা-সেবার সাথে জড়িত এমন অনেক ত্যাগি সেনাদের দেখা মিলেছে। যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও স্বজনদের নিষেধ উপেক্ষা করে জীবন উৎসর্গ করার নিয়তে করোনাক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসা-সেবা প্রদান করে চলেছেন। তন্মধ্যে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সহকারি সার্জন ডা. মশিউর রহমানের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। যিনি জেনে শুনে করোনা হটস্পট জেলা নারায়নগঞ্জে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে বদলীর আবেদনের মাধ্যমে নারায়নগঞ্জে বদলি হয়ে করোনা রোগিদের চিকিৎসা-সেবা প্রদান করে চলেছেন।
ডা. মশিউর রহমান ৩৯ তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক। তার কর্মস্থল ছিলো সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার দোবিলা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগিদের দুর্দশা ও কষ্ট দেখে তাদের চিকিৎসা করানোর জন্য নিজেই আবেদন করে বদলি হয়ে নারায়নগঞ্জে যান। অথচ সেসময় নারায়নগঞ্জের জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন (প্রাক্তন জেলা প্রশাসক পাবনা), কমিটির সদস্য সচিব সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ, ফোকাল পার্সন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামসহ সরকারি -বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং অগণিত সাধারণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত।
গত ৬ মে-২০২০ সন্ধ্যায় একটি পত্রিকার সাংবাদিকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় ডা. মশিউর রহমান বলেন, তার নানা একজন বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। পিলখানার ৩ নম্বর গেইটটি তার নানার নামে নামকরণ করা হয়েছে। তিনি হলেন বীর উত্তম সুবেদার হাবিবুর রহমান। ডা. মশিউর রহমান বলেন, ‘‘ আমি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কর্মরত ছিলাম। কিন্তু সেখানে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোন করোনা রোগি ছিলোনা। ঢাকা ও নারায়নঞ্জ আমাদের চিকিৎসকরা করোনা রোগিদের চিকিৎসা করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। রোগির সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু চিকিৎসক তো সব জায়গায় সীমিত। আমি দেখলাম সিরাজগঞ্জে বসে থেকে কোন লাভ নেই। তাই মনে মনে ইচ্ছা জন্মালো আমি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগির সেবা করতে পারতাম। জাতির এই সময় যদি পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে আমার মেধা ও পরিশ্রম কাজে লাগবে। কিন্তু হঠাৎ করে উপায় মিলছিলোনা। তাই উপায় খুঁজতে লাগলাম। যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বদলি হতে চাই তাহলে ফাইল চালাচালি ও অর্ডার হতে সময় লাগবে। তাই আমি নিজেই ২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর নারায়নগঞ্জে বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করলাম। এর মধ্যে আমি আমার মায়ের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করলাম। মা তখন আমাকে বল্লো, সব উপজেলা ও জেলাই তো আক্রান্ত হতে পারে। তুমি যদি নারায়নগঞ্জে যেতে চাও সিদ্ধান্ত তোমার। আমি মাকে বুঝালাম, যথাযথ প্রটেকশন পেলে আমি আক্রান্ত হবোনা। আমার পরিবার আমার সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। তারা সায় দিলেন। তবে তাদের দুশ্চিন্তা কমেনা।
বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিকের কাছে ডা. মশিউর তার আবেদন পত্রের বিষয় বস্তুও তুলে ধরেন। তিনি তার আবেদনে উল্লেখ করেন, আমি ঢাকা কিংবা নারায়নগঞ্জের হটস্পট এলাকায় করোনা রোগিদের চিকিৎসা-সেবা দিতে ইচ্ছুক। কারণ আমার নানা বীর উত্তম সুবেদার হাবিবুর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত¦। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৬ বছর তিনি পঙ্গু থাকার পর ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। নানার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমিও করোনা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই। এরপর ২৭ এপ্রিল তিনি বদলি হয়ে নারায়নগঞ্জের ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে কাজে যোগদান করেন।
করোনা নাইনটিন ওয়ারে শুধু ডা. মশিউর রহমানই নয়,স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে সারা দেশে ২৭ হাজারেরও বেশি ডাক্তার রয়েছেন। এর সাথে রয়েছেন অসংখ্য নার্স এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারি বৃন্দ। যারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে মহামারি করোনা রোগির চিকিৎসা -সেবা দিয়ে চলেছেন।
বাংলাদেশে কোভিড নাইনটিন ওয়ার ফিল্ডে কোভিডে আক্রান্তদেরকে চিকিৎসা-সেবা প্রদান করতে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অনেকেই। চিকিৎসকদের মধ্যে সর্ব প্রথম যিনি এই যুদ্ধের নিবেদিত সৈনিক হিসেবে জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি হলেন, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজেরে মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন। সাহসী, মানবিক, সৎ ও পরিশ্রমী চিকিৎসক হিসেবে সবার কাছে একজন প্রিয়ভাজন ডাক্তার ছিলেন তিনি। নিজে কোভিড-নাইনটিনে আক্রান্ত হবার পরও টেলিফোনে রোগিদের খোঁজ খবর নিতেন।সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মন্ডল বলেন, গত ৫ এপ্রিল বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকাবস্থায় ডা. মঈন উদ্দিন করোনার পরীক্ষায় পজিটিভ হবার পর তাকে নগরীর শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ৮ এপ্রিল শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স যোগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রী একজন ডাক্তার। তিনিও সঙ্গে গিয়েছিলেন। গত ১৫ এপ্রিল সকাল বেলা তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি দুটি নাবালেগ সন্তান রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে সিলেট এমএ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ গোটা সিলেটেই শোকের ছায়া নেমে আসে। জানা যায় অনেক সিনিয়র প্রফেসর তার জন্য নীরবে অশ্রæপাত করেছেন।
কোভিড নাইনটিন ওয়ারে চিকিৎসা-সেবা দিতে গিয়ে দ্বিতীয় সৈনিক যিনি ইন্তেকাল করেছেন, তিনি হলেন, ডাক্তার আব্দুর রহমান। গত ২৬ মে করোনার উপসর্গ নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। করোনা রোগির চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে এপর্যন্ত এমন বহুসংখ্যক ডাক্তার সৈনিক কোভিড নাইনটিন ওয়ারে মৃত্যুবরণ করেছেন। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।