রাজনীতিকদের লেখনি ভাল অবদান রাখতে পারে –আলাউদ্দিন আহমেদ


আমরা যারা মিডিয়া জগতে কাজ করে দেশের জন্য ও জনগনের প্রতি কিছুটা দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করছি তারাও মাঝেমধ্যে দৈন্যতায় পড়ি। এ দৈন্যতা অবশ্য অন্য কিছু নয়, লেখালেখি সংক্রান্তই।

জাতীয় পর্যায়ে আমাদের কিছু বিশেষ দিবস আছে। যেমন; স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস. নারী দিবস ইত্যাদি। স্বাভাবিক কারনে এসব দিবসের উপরে স্থানীয় সংবাদপত্রে বিষয়ভিত্তিক লেখা দেয়া হয়।
এক সময় ছিল সাবেক ছাত্রনেতারা সহজেই দিবসগুলোর উপর লিখতে পারতেন। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির অনেক কিছুই ওলোটপালোট হয়ে গেছে। এখন রাজনীতি করতে তেমন বই-পুস্তক পড়তে হয়না। গদবাধা কিছু শ্লোগান আর কথা জানলেই বড় নেতা হওয়া যায়। ফলে কোন সাবেক ছাত্রনেতাকে যদি বলা হয়, ভাই তুমি জাতীয় শোক দিবসের উপর একটি লেখা জনদাবীতে দিও। দেখা যাবে লেখা তো দুরের কথা, তিনি পরদিন থেকে আর জনদাবী অফিসেই আসছেননা-!
পত্রিকায় দিতে না চাইলে তিনি ফেসবুকেও দিতে পারেন। কিন্তু না আমরা ঈশ্বরদীতে তাও দেখতে পাইনা। অথচ এখানে নেতার কোন অভাব নেই।

পাবনা-৪ সংসদীয় আসনটি ঈশ^রদী ও আটঘরিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। ঈশ^রদী উপজেলায় ভোটার সংখ্যা নতুন (১৯ হাজার ৭৩৭) সংযোজনসহ ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৪২ জন। আটঘরিয়ার চেয়ে জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যা এখানে বেশি। সবসময় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সক্রীয়তা বিবেচনায় ঈশ^রদীর নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। আওয়ামীলীগ ও বিএনপির ঈশ^রদীর নেতৃবৃন্দই এই আসনের এমনকি পাবনা জেলারও নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। ঐতিহ্যবাহি আওয়ামীলীগের যেমন নেতার কোন অভাব নেই; আবার বিএনপিরও ক্ষমতায় থাকাকালীণ বহু নেতা ছিলেন।
স্থানীয় সংবাদপত্র পরিচালনায় আমাদের মাঝে মাঝে অভাবে পড়তে হয়। এই অভাবটি অবশ্য অন্য কোন কিছু না, লেখার অভাব। জনদাবীতে সব সময়ই রাজনৈতিক লেখাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। সেই বিবেচনায় আমরা সব সময় আশা করি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই লিখবেন তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে। কিন্তু এইক্ষেত্রে দৈন্যতা আছে। খুব একটা লেখার অভ্যাস গড়ে তোলেননা নেতারা।

তবে অনেক অপ্রাপ্তীর মধ্যেও ইদানিং কয়েকজন নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখছেন। এঁদের মধ্যে জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি পাঞ্জাব বিশ^াস এর বিভিন্ন বিষয়ের উপর মন্তব্য লেখা দেখি।
পাবনা জেলার অন্যতম একজন সুবক্তা হিসেবে পরিচিত পাঞ্জাব বিশ^াস একাধারে রাজনীতিক; অন্যদিকে উচ্চমানের একজন সাহিত্যিকও। তাঁর অনেক সুলেখা আমি পড়েছি। সহজেই পাঠক আকৃষ্ট করার মত লেখনি শক্তি তাঁর আছে। তাঁর একটি কবিতা:
প্রিয় স্বাধীনতা এখনো কেনো তোমার চোখে জল!
বিদগ্ধ জননী হারায় চোখের কাজল!
ত্রিশ লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে নির্ঘুম ইতিহাস
সোনালী শস্য ক্ষেতে আঁধারের লাশ
কতকাল আর কতকাল!
উর্বর পলিতে হবে ঘৃণিত আকাল!

সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমান স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম লিটন এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী বর্তমান বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক ড. মুসলিমা জাহান ময়নাকে দেখি ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বল্প পরিসরে লেখেন। নেতাদের মধ্যে কেউ কিছু লিখলে আমি মনযোগ দিয়ে তা পড়ার চেষ্টা করি। তাঁদেরও নিশ্চয় পড়ার অভ্যাস আছে। তা নাহলে লিখতে পারতেননা।
রাজনীতির উপর লেখা সাবেক ছাত্রনেতাদেরই শোভা পায়। খারাপ দিক হচ্ছে এই সংখ্যা সারাদেশে কমতে কমতে দু:খজনক অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা জাতির জন্য ভাল কিছু বয়ে আনবেনা।

লিটন অন্তত লেখনির মাধ্যমে তার সৃজনশীলতা প্রকাশের আগ্রহ দেখান। নিজেকেও তুলে ধরার দৈন্যতায় ভোগেননা। এইক্ষেত্রে লেখালেখি তাকে অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করবে বলে মনে হয়। তার সাম্প্রতিক কয়েকটি লেখা পড়লাম; ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস সম্পর্কে, ৯০ এর আন্দোলনের স্মৃতিচারণ, প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম ও আনিসুন্নবী বিশ^াসকে নিয়ে লেখা ইত্যাদি।

আমাদের সমাজে নারীদের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে অনেক বাধা। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে নানানভাবে তাদের অগ্রগতিকে অবমূল্যায়ন করা হয়। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারীর ক্ষমতায়নের দিকে নজর দিয়েছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদেরকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। একশ্রেনীর পুরুষ আছে যারা নিজের অযোগ্যতাকে আড়াল করতে উচ্চশিক্ষিত নারীদের মেনে নিতে চাননা। পুরুষতান্ত্রিকতার এই অপচিন্তার বিরুদ্ধে শিক্ষিত মেয়েরা এখন অনেক সাহসি ভূমিকায় এগিয়ে আসছেন। এটা আমাদের সুস্থ্য সমাজ কাঠামো বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এমনই একজন উচ্চশিক্ষিত সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী ও বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক ড. মুসলিমা জাহান ময়না। করোনা ভাইরাসের মধ্যেও তিনি ঈশ^রদী ও আটঘরিয়া উপজেলায় করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বানসহ মাসব্যাপী উপকরণ বিলি করেছেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নিয়মিত ফেসবুকে লিখছেন। মাঝেমাঝে জনদাবীতেও তাঁর লেখা ছাপা হচ্ছে। সম্প্রতি তার কয়েকটি লেখার শিরোনাম; আদর্শ ও তার ধারক, জনপ্রতিনিধিদের অবসর ভাতা, রাজনৈতিক উপলব্ধি: সাংসদের ‘টার্মস অব রেফারেন্স’, মানুষ কেন মানুষ খায়– ইত্যাদি।

আকরাম আলী খান সঞ্জু বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীণ একজন ডাকসাইটে নেতা ছিলেন। আলোচনা-সমালোচনার কোন অভাব তার ছিলনা। অনেক কিছুর পরও তার অন্য একটি গুনও রয়েছে, সেটা হচ্ছে সাহিত্য চর্চায় মনযোগী হওয়া। স্থানীয় সংবাদপত্র ও ফেসবুকে মাঝেমাঝেই সঞ্জু খানের লেখা পড়ার সুযোগ হয় অনেকের। তার সুন্দর শব্দ চয়ন ও সাবলীল লেখাগুলো বেশ মনোমুগ্ধকর। গল্প আকারেও তিনি অনেক বাস্তবতা তুলে ধরেন। তার লেখার কয়েকটি শিরোনাম মনে পড়ছে; পরাধীনতায় বসবাস, নি:সঙ্গ জীবন, মনে পড়ে, মায়ের কাছে শেষ চিঠি, নেপালে ঈদ ইত্যাদি। মেধার প্রতিফলন আছে সঞ্জু খানের লেখায়।

ঈশ^রদীর সন্তান সিপিবি’র কেন্দ্রীয় রাজনীতির সাথে জড়িত বীরমুক্তিযোদ্ধা শামছুজ্জামান সেলিম রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী অনেক লেখা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লেখেন। তাঁর লেখা পড়ে যেকোন দলের নেতাকর্মীরা জানতে ও শিখতে পারেন।

উল্লেখিত মানুষগুলো অন্যান্য লেখার পাশাপাশি জেলার রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখলে পাঠকরা তা থেকে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারতো। স্থানীয় সংবাদপত্রে লেখা দিতে তাদের কোন সমস্যা থাকলে ফেসবুকে অনায়াসে দিতে পারেন। আমাদের আশা এইক্ষেত্রে অন্তত: শূন্যতাটুকু তাঁরা পূরণ করতে আরো বেশি সময় দেবেন।

একজন লেখক কখনো সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য অর্থাৎ সার্বজনীন হতে পারেন বলে আমি মনে করিনা। ভিন্নমত থাকতেই পারে। সেইক্ষেত্রে পাল্টাপাল্টি বিতর্ক তৈরি না করে নিজে যেটা সত্য ও সঠিক মনে করবেন সেটাই লেখনিতে তুলে ধরা যৌক্তিক। পাঠকরাই বিবেচনা করবেন কোনটা সঠিক অথবা কোনটা বেঠিক।
তবে রাজনৈতিক নেতারা যখন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর লিখবেন তখন দলের কিছু মানুষের সমর্থন হারানোর শংকায় যদি লেখেন তাহলে তার লেখালেখির দরকার নেই। কারন সবক্ষেত্রে নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে ইনিয়ে-বিনিয়ে কোন কিছু লেখার আঙ্গিকে উপস্থাপন করায় এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এতে নতুন প্রজন্ম ভুল তথ্যগুলোই জানবে যা সুষ্ঠুধারার সংস্কৃতি চর্চার অন্তরায় হবে।

রাজনীতির ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রগতিশীল লেখক. সাংবাদিক. বুদ্ধিজীবীদের পছন্দ করতেন, তাঁদের নিয়ে আড্ডা দিতেন, মতবিনিময় করতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া মাঠ পর্যায়ের অনেক সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও এই গুনাবলী ছিল যা তাঁদের মৃত্যুর পর নতুনদের মধ্যে এখন আর চোখে পড়েনা। এখন একটি বড় অংশের মধ্যে শুধু চেয়ারে যাওয়া আর ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের প্রতিযোগিতা চলে। ভোগবিলাসী মানসিকতার কারনে সৃজনশীলতার অভাব চারিদিকে।
সামাজিক অনাচার দুর্বৃত্তায়ন থেকে জনগনকে উদ্ধার করতে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারনকারি সৃজনশীল লেখকরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে আমাদের দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন সংগঠিত করার পিছনেও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা ও প্রগতিশীল লেখকদের স্মরণীয় ভূমিকা ছিল যা বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।
( লেখকঃ ঈশ্বরদীর সিনিয়র সংবাদকর্মী ও কলামলেখক। সাবেক সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব)।