বিশ^ ব্যাপি এখন যুদ্ধ চলছে।‘ কোভিড নাইনটিন ওয়ার্ল্ড ওয়ার বা করোনা যুদ্ধ।’ বিশে^র প্রায় ২১০টি দেশেই এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও এই যুদ্ধের কবল থেকে বাদ পড়েনি। বাংলাদেশের মানুষ ন¤্র- ভদ্র ও শান্তি প্রিয়। সময় সুযোগ পেলে তারা অতি আরাম আয়েশে দিন গুজরান করে। বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দুরন্ত আশা’ কবিতার একস্থানে লিখেছিলেন,‘‘ ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো/ পোষ মানা এ প্রাণ / বোতাম আটাঁ জামার নীচে/ শান্তিতে শয়ান।’’
তবে যেকোন অন্যায় অত্যচার বা অবিচারের বিরুদ্ধে তারা সকল সময়ই সোচ্চার। বিশেষ করে তারা যেকোন অজাচিত আঘাতকে প্রহিত করতে নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ১৯৬৫ সালের পাক- ভারত যুদ্ধ বা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার সেপ্টেম্বরের যুদ্ধ। কোভিড নাইনটিন ওয়ার বা করোনা যুদ্ধের মত উপমহাদেশবাসি হঠাৎ করেই এদিন রেডিওতে শুনতে পেলো , পশতুর উপভাষা হিন্ডকোর টানে উদর্ৃুতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান বলছেন,‘‘ মেরে আজীম হামওয়াতানো! জঙ্গ শুরু হো চুকি হ্যায়।’’ জবাবী ভাষণ দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বলেন, ‘‘ জয় জোয়ান, জয় কিষাণ!’’ সর্বাত্মকভাবে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ।
৬ সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি সন্তানদেরকে আহ¦ান জানায়। যুব সম্প্রদায়ের মাঝে অনেকেই সে আহবানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যেতে আগ্রহি হয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে থাকে। শুধু কি তাই স্কুল কলেজের ছাত্রদেরকেও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদেরকে প্রস্তুত থাকারও ব্যবস্থা করা হয়।
আমি তখন পাবনা আরএম একাডেমির (রাধানগর মজুমদার একাডেমি) নবম শ্রেনীর ছাত্র। আর এই যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণের জন্য আমাদের স্কুলে সেনাবাহিনীর অফিসার এসে যারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধে যেতে আগ্রহি তাদেরকে নাম লেখাতে বলেন। এতে আমরা অনেকেই নাম লিখাই। অতঃপর আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়। কে জানতো পাকিস্তান রক্ষার জন্য সেদিন যে ট্রেনিং পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধেই আবার তাদের দেওয়া ট্রেনিং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে। যাক, আমাদেরকে যুদ্ধের সময় বিমান হামলা হলে তাৎক্ষনিক কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাতে ব্লাকআউট বা নি®প্রদীপ মহড়া কেমন ভাবে দিতে হবে, ট্রেঞ্চ কিভাবে খনন করতে হবে, বোমা ফেলার সময় কেমনভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে, লোকজনকে কোথায় কিভাবে সরিয়ে নিতে হবে, আহতদের কিভাবে সেবা করতে হবে, এক কথায় ফাস্টএইড ও সিভিলডিফেন্স সংক্রান্ত সর্বপ্রকার ট্রেনিং এর ক্লাস হতো। আর বেশিরভাগ ক্লাসই নিতেন বাঙালি ডাক্তার ও পাকিস্তানি আর্মি অফিসাররা। এধরনের প্রশিক্ষণের পর ডামি রাইফেল চালনা, অতঃপর থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল চালনার জন্য আমাদেরকে পাবনা পুলিশ লাইনস্ মাঠে নিয়ে গিয়ে রীতিমত রাইফেল শুটিংয়ের প্রশিক্ষণও প্রদান করা হলো। এ ধরনের ট্রেনিং দিয়ে শেষে আমাদেরকে যুদ্ধের মহড়ায় প্রশিক্ষিত করা হলে যুদ্ধে যাবার জন্য তৈরি থাকতে বলা হলো। সেসময় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পাক- ভারত যুদ্ধ থেমে যায় বলে আমাদেরকে আর যুদ্ধে যেতে হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছিলেন তাতো আর ভুল হবার নয়।
সেই যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত যে সকল বাঙালি অফিসার ছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেন, মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোর্শারফ, আবু তাহের, আবুল মন্জুর প্রমুখ। যতদুর জানা যায়, সে যুদ্ধে জিয়াউর রহমান ৪৬৬ জন সৈন্যের একটি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। সেই বাহিনী প্রথম ভারতীয় বাহিনীর সামনে পড়ে। তাজুল ইসলাম নামে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন এনসিও নিজের বুকে মাইন বেঁধে আগুয়ান ভারতীয় ট্যাংক বহরের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহুতি দেন। ফলে ভারতীয় সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। স্থল বাহিনীর পাশাপাশি বিমান বাহিনীতে কর্মরত বিমান সেনারাও এই যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখান। বাঙালি বৈমানিক মোহাম্মদ মাহমুদুল আলম বিমান যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা রেকর্ড গড়ে একটি হীনবল এফ- ৮৬ স্যাবর জঙ্গি বিমান দিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এক মিনিটে ৫ টি ভারতীয় হান্টার বিমান ভুপাতিত করেন, যার মধ্যে প্রথম ৪ টি ভুপাতিত করেন ৪০ সেকেন্ডের মধ্যেই। আরেক বাঙালি বৈমানিক (যার বাড়ি পাবনা জেলার ফরিদপুর থানায়) সাইফুল আজমও বীরত্বের সঙ্গে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে ডগফাইট করেন এবং একটি জঙ্গি বিমান ভুপাতিত করেন। এই যুদ্ধের সময় ভারতের সেনা প্রধান ছিলেন জয়ন্ত নাথ চৌধুরী ওরফে জে এন চৌধুরী। যাঁর আদি নিবাস পাবনা জেলার চাটমোহরের হরিপুরে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমন বীরত্বের ভুরি ভুরি কাহিনী রয়েছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত তার পরিবারের কথা না ভেবে পাকিস্তানের জঙ্গি বিমান দখল করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় তিনি বিমানের সেফটি অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২০ আগষ্ট ২১ বছর বয়সি রাশেদ মিনহাজ নামে একজন শিক্ষা নবীশ পাইলটের উড্ডয়নের সময় সেই বিমান নিজের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি ক্ষমতাবলে পাইলট রাশেদ মিনহাজকে বিমান থামাতে বলেন এবং তিনি ককপিটে আরোহন করেন। পরে পাইলটকে ক্লোরোফরম দিয়ে অজ্ঞান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাইলট জ্ঞান ফিরে পেয়ে কন্ট্রোল টাওয়ারকে বিষয়টি জানান। ইতোমধ্যে দুজনের ধব্স্তা ধবস্তি শুরু হয়। এদিকে রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর ৪টি বিমান তাকে ধাওয়া করে। তিনি ভারতীয় সিমানার কাছাকাছি পৌঁছে যান। কিন্তু পাইলট এক পর্যায়ে ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে সিটকে পড়েন এবং ভারতীয় সিমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দুরে খাট্টা এলাকায় এঘটনা ঘটে। বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মতিউরের সাথে প্যারাস্যুট না থাকায় তিনি নিহত হন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ২০০৬ সালের ২৪ জুন শহীদ মউির রহমানের দেহাবশেষ করাচির মাসরুর ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থান হতে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।
কোভিড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে বাংলাদেশেও ডাক্তার, নার্সসহ কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা-সেবার সাথে জড়িত এমন অনেক ত্যাগি সেনাদের দেখা মিলেছে। যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও স্বজনদের নিষেধ উপেক্ষা করে জীবন উৎসর্গ করার নিয়তে করোনাক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসা-সেবা প্রদান করে চলেছেন। তন্মধ্যে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সহকারি সার্জন ডা. মশিউর রহমানের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। যিনি জেনে শুনে করোনা হটস্পট জেলা নারায়নগঞ্জে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে বদলীর আবেদনের মাধ্যমে নারায়নগঞ্জে বদলি হয়ে করোনা রোগিদের চিকিৎসা-সেবা প্রদান করে চলেছেন। ! (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১ ঊসধরষ: বনধফধঃধষর ১৯৭১ @ মসধরষ .পড়স তারিখ: ০৭/০৮/২০২০.