যে কোন দেশে যুদ্ধ শুরু হলে সেদেশের সৈনিকদের থাকা-খাওয়া ও প্রয়োজনীয় রসদপত্র সে দেশের সরকারই স্বতস্ফুর্তভাবে সরবরাহ করে থাকে।
যেমন ১৯৭১ সালে আমদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার অথ্যাৎ মুজিবনগর সরকার প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের মাটিতে বসে বিভিন্ন কমান্ডিং অফিসার ও মুক্তিফৌজদের মাসিক মাইনে দিতেন। তখনকার বাজার অনুপাতে মুক্তিফৌজদের কমান্ডিং অফিসার পেতেন ৫০০ ভারতীয় রুপি, অফিসার ৪০০ রুপি, অফিসার ক্যাডেট ১০০ রুপি, জুনিয়র কমিশন্ড
অফিসার (জেসিও) ১৫০ রুপি । মুক্তিফৌজের ননকমিশন্ড অফিসার এবং নিয়মিত বাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের বেতন ছিলো ৭০ ও ৭৫ রুপি।
অন্যদিকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণকালে ৩০ রুপি এবং প্রশিক্ষণ শেষে ৫০ রুপির এককালিন ভাতা পেতেন। দেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর সময় দিন হিসাব করে তাদের জন্য প্রতিদিন ২ রুপি অর্থাৎ মাসে তারা
পেতেন ৬০ টাকা। বেতনের পাশাপাশি দুই সেট খাকি ইউনিফর্ম এবং হালকা বিছানা পেতেন নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা। আধা সামরিক বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা পেতেন লুঙ্গি, শার্ট ও পিটি স্যু। এর
বাইরে স্থানীয় সুত্র থেকে কম্বলসহ থালাবাসন ইত্যাদি জোগাড় করে নিতেন তারা। গেরিলা মুক্তিফৌজদের যাতায়াতের জন্য বর্ষাকালে ছয় দাঁড়ের নৌকা এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ সরবরাহ করা
হতো।
বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা যুদ্ধকালে প্রথম কাতারের সৈনিক অর্থাৎ কোভিড-১৯, সমরের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইরত সৈনিক ডাক্তার, নার্সদের
বিরুদ্ধে থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত ভাড়ার ২০ কোটি টাকা নিয়ে টাকার অংকে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারনা হচ্ছে। যা নাকি জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এ নিয়ে সংসদে
বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিন এ
প্রকাশিত ‘ ঢাকা মেডিকেলের চিকিতসক, স্বাস্থ্যকর্মিদের থাকা-খাওয়ার খরচ ২০ কোটি টাকা শীর্ষক খবর উদ্ধৃত করে স্বাস্থ্য খাতে
অপচয় ও দুর্নীতি নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্যকর্মিদের খরচ ২০ কোটি টাকার মত হয়েছে।
যার মধ্যে খাবার খরচই প্রায় অর্ধেক। কত টুকু প্রয়োজন ছিলো, কতটুকু অপচয় ও দুর্নীতি হয়েছে এখন পর্যন্ত জানিনা। তিনি থোক
বরাদ্দের ব্যাপারে যথার্থতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সমন্বয় কমিটি গঠনের দাবি জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বাজেট অধিবেশনে অংশ নিয়ে তিনি এ দাবি জানান।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।
কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা। বিরোধী দলীয় উপনেতা ঠিকই বলেছেন, ২০ কোটি টাকা ব্যয় অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এটা আমরা পরীক্ষা করে
দেখছি।’’ তিনি আরো বলেন, দুর্নীতি করলে ছাড় নয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে করোনায় আক্রান্তদের সেবাদানকারি চিকিতসক নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মিদের খাবারে ২০ কোটি টাকা খরচ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের
উত্থাপতি প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘‘ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি কোন অনিয়ম হয় ব্যবস্থা নেবো।’’ দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের উন্নয়নের ধারা
অব্যাহত এবং আমাদের অজর্নসমূহ সমুন্নত রাখতে সরকার দুর্নীতিবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখবে।’’
জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন,‘‘ ঢাকা মেডিকেলের জন্য ৫০ টি হোটেল ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ৩ হাজার ৭ শ লোক ১ মাস থেকেছেন। হিসাব করে বের করেছি ১ হাজর ১০০ টাকায় প্রতিটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছে। খাওয়ার বিল তিন বেলায় ৫০০ টাকা। ’ গত দুই দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এসব নিয়ে চিকিৎকরা বিব্রত।’’ ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বলেছেন, হাসপাতালে অনিয়ম হলেই চিকিতসকদের দিকে আঙুল তোলা হয়। কিন্তু এসবের সঙ্গে চিকিতসকেরা জড়িতনা। ঢাকা মেডিকেলের প্রাক্তন ছাত্র ও স্বাধীনতা চিকিতসক পরিষদের সভাপতি ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘‘ এসব কাজে চিকিতসকেরা কোনদিনই জড়িত থাকেনা, এই ক্ষেত্রেও জড়িতনা। এসব ঘটনা, খবর চিকিতসকদের হতোদ্যম করে।’’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে চিকিৎসকসহ ২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মির জন্য মাসে ২০ কোটি টাকা খরচের বিষয়ে
প্রচারিত খবরের প্রতিবাদ জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলেন, খাওয় বাবদ এত টাকা খরচ করা হলে প্রতি বেলায় তাদের বুফে খাওয়া-দাওয়া করা সম্ভব হতো। ভুতুড়ে এ বিলের সঙ্গে চিকিতসকদের সম্পৃক্ততা নাই
উল্লেখ করে এব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রকাশের দাবি জানান।’’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলশানের হোটেল স্ট্রিং হিলে অবস্থানরত একজন চিকিতসক মেডিভয়েসকে বলেন, খাাবার-দাবারের মান একেক হোটেলে একেক রকম। এটা নির্ভর করে আমরা আসলে কোথায় অবস্থান করছি।
এখানে দুই লিটার একটি পানির বতলের দাম রাখা হয় ১২০ টাকা। যা বাইরে মাত্র ৩০ টাকা। হোটেলের হিসাবটা আলাদা। আমাদের খাবারের মান মোটামুটি ভালো। খাবার বাবদ যত খরচ দেখানো হয়েছে , এতো আসার কথা না। আমাদের সকালের নাস্তায় দুটি পরেটা, একটি ডিম ভাজি ও সবজি থাকে। এতে সর্বোচ্য ১০০ টাকা আসতে পারে। দুপুরে
একটি এক প্লেট ভাত, ভর্তা, ডাল আর মাছ অথবা মুরগি দেওয়া হয়।
এজন্য সর্বোচ্য আড়াইশ থেকে তিন শ টাকা বিল আসতে পারে। এভাবে রাতের খাবারে সমপরিমাণ খরচ হবে। এহিসেবে দিনে সর্বোচ্য ৭-৮ শ টাকা আসতে পারে। সেখানে দিনে দেড় হাজারের উপরে খরচ দেখানো হয়েছে এটা অভাবনীয়।’’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবাদানকারি চিকিৎসকদের ১ মাসের খাবার খরচ বাবদ ২০
কোটি টাকা শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা ও বানোয়াট বললেন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার
জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। গত ১ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। নাসির উদ্দিন বলেন, ‘‘ গত দুই মাসে করোনা রোগীদের চিকিতসায়
নিয়োজিত ছিলেন চিকিতসক, নার্স, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি এবং আনসার সদস্যসহ মোট ৩,৬৮৮ জন। ডিউটি রোস্টার
অনুযায়ী তারা এক সপ্তাহ করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি করার পর পরবর্তী তিন সপ্তাহ আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। এ হিসাবে
প্রত্যেককে এক মাস করে আবাসিক হোটেলে অবস্থান করতে হয়। তিনি বলেন, গত দুই মাসে আবাসিক হোটেল ভাড়া, দৈনিক তিন বেলার খাবার এবং যাতায়াত ভাতা বাবদ সম্ভাব্য ব্যয় ২৬ কোটি টাকা হিসাব ধরে
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে চিকিতসকদের এক মাসের খাবার খরচ বাবদ ২০ কোটি টাকা শীর্ষক প্রতিবেদন সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান বলেছেন,‘‘ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাম্প্রতিক
করোনা পরিস্থিতিতে চিকিতসকদের থাকা, খাওয়া বাবদ ব্যয় তদন্ত করে খতিয়ে দেখা হবে।’’। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।