অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত এক শিকলেই গাঁথা। বর্তমান যখন সময়ের স্রোতে বিলীন হয় তখন তা হয় অতীত। আর আগামির চিন্তা চেতনা কর্ম ভবিষ্যতের অন্তর্ভুক্ত। অনাদিকাল থেকে ধীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘটছে বিবর্তন। বিবর্তন ঘটছে চিন্তার-চেতনার। বিবর্তন ঘটছে জীব বৈচিত্র, পরিবেশেরও। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটছে, বিকাশ ঘটছে । নব-নব আবিষ্কার আমাদের অবাক করছে। ছাপার বইয়ের স্থান দখল করছে ই-বুক। অনলাইন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে আমরা যে কোন খবর মুহুর্তেই পেয়ে যাচ্ছি। এতদ পরিবর্তন সত্বেও বইয়ের বিকল্প ভাবাই অকল্পনীয়। আর বইয়ের লাইব্রেরী ? বইকে যদি টিলা ভাবি তবে আকার ভেদে;বইয়ের সংখ্যানুযায়ী লাইব্রেরী গুলো সুউচ্চ পাহাড় বৈ কিছু নয়। যে লাইব্রেরী যত বেশি বইয়ে সমৃদ্ধ সে লাইব্রেরী যেন ততটাই সু-উচ্চ।
বইয়ের সাথে লিফটের সাদৃশ্য-বৈশাদৃশ্য তুলনা পূর্বক এ প্রবন্ধটিকে এগিয়ে নিতে চাই। লিফট্ যেমন কিছু সংখ্যক মানুষকে বহুতল ভবনের উপরে তোলে বই তার চেয়ে অনেক বেশি; অগনিত মানুষকে উপরে তোলে। বিকশিত করে অগনিত মানুষের চিত্ত। তবে লিফট্ যেমন মানুষকে নিচে নামায় তেমন করে বই বা বইয়ের জ্ঞান মানুষকে নিচে নামায় না। বইয়ের জ্ঞানের অভাবে অগনিত সংখ্যক মানুষ যে বেহুশ হয় তার প্রমান ও আমরা নেহায়েত কম পাই না। একটা নির্দিষ্ট এলাকার গুটি কতক মানুষ পন্ডিত বা গুনী হইয়াছে বলিয়া যে সে এলাকার মানুষের আর বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা নেই এমন ধ্যান ধারণা হৃদয়ে পোষণ করলে সে এলাকায় আর পন্ডিত ব্যক্তি জন্মাইবে কি করিয়া।
সব মানুষ লাইব্রেরীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। করার কথাও নয়। তবে সমাজে এখনো কিছু সংখ্যক এমন মানুষ আছেন যারা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চুড়ায় আরোহন করতে চান। সে বইয়ের পাহাড় হোক আর বাস্তবিক। কেউ মাউন্ট এভারেষ্ট জয় করেন আবার কেউ বইয়ের পাহাড়। তবে যারা জয় করেন আমরা তার জয়গানে মুখর হই। আবার এমন অনেকে আছেন যারা আদৌ কোন পাহাড় চুড়াতেই উঠতে চান না। না চান বই পড়তে; না চান হৃদয়ের মাঝে আপন ভূবন গড়তে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা সুউচ্চ পাহাড়ে ওঠেন তাদের কিংবদন্তী ভাবতেও কৃপণতা করেন তারা। বড় হওয়ার চেষ্টা না করে তারা ভাগ্যকে নিরবে দূষলেও সরবে স্বীকার করতে নারাজ। এমনটা স্বভাবে মিশে থাকলে আমাদের তা পরিত্যাগ করা অতীব জরুরী।
হাতের কাছে পাঠ্য পুস্তক বা সহায়ক অন্য কোন ছাপার বই নেই। তাতে কি? একটা স্মার্টফোন হাতে থাকা মানেই একটা বই এমনকি একটা লাইব্রেরী হাতে থাকা। শুধু চাই পড়ার ইচ্ছা। শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ নীতি, দর্শন, কি নেই সেখানে ? জ্ঞানান্বেষণে সাগরে সাঁতার কাটার দরকার নেই, প্রয়োজন শুধু ইচ্ছা শক্তির। ইন্টারনেটে আমরা ভাল-মন্দ দুইই পেতে পারি। মন্দটাকে উপেক্ষা করে আমরা যদি ভালো দিকটা বেছে নেই, চর্চা করি তবে তা কল্যান বয়ে আনবে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের উচিত পাহাড় সংরক্ষণ করা। অসাধুরা পরিনাম না ভেবে পাহাড় কেটে মাটি সরিয়ে নেন। ঘড় বাড়ি তৈরী করেন। অত্যাচার করেন প্রকৃতি, পরিবেশের উপর। এর প্রভাবে পরিবেশ যেমন ভারসাম্য হারায় তদ্রুপ আমরা যদি বইয়ের যত্ন না নেই, বই না পড়ি, লাইব্রেরী মুখী না হই, লাইব্রেরীর যত্ন না নেই, জরাজীর্ণ লাইব্রেরীগুলো সংস্তার না করি তবে পাহাড় ধসের মতো আমাদের জ্ঞানের উচ্চতায় ও ধস নামতে বাধ্য।
“ক্যারেবা আমি কার খালু ? শিরোনামে লোক মুখে প্রচলিত একটি গল্প স্মরণ করাইয়া দিয়া এ প্রবন্ধের যবনিকা টানতে চাই। গল্পের মর্ম কথা এমন যে, কোন এক এলাকায় একজন ধুরন্ধর অন্ধ লোক বাস করিতেন। জ্ঞানের নাড়ী টনটনা হওয়ায় অন্ধ হওয়া সত্তে¡ও কেউ তাকে ঠকাইতে পারিত না। সে মনস্থ করিল ভায়রা ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াইতে যাইবে। একথা সে তার প্রতিবেশি এক যুবকসহ আরো কিছু লোককে বলিয়াছিল। নির্দিষ্ট দিনে ভায়রার বাড়িতে বেড়াতে যাবার সময় নিকটস্থ হাটে গিয়ে মিষ্টি কেনে অন্ধ লোকটি। টাকা পরিশোধ করে অন্ধ লোকটি যখন মিষ্টির হাড়ি হাতে গমনোদ্যত এমন সময় সালাম দিয়ে প্রতিবেশি যুবক তাকে জানায় সে তার ভায়রা ভাইয়ের ছেলে। খালু সম্বোধন করে প্রতিবেশি যুবক কুশলাদি বিনিময় করে খালুর কষ্ট লাঘবে মিষ্টির হাড়িটি খালুর হাত থেকে নিয়ে অন্ধ লোকটির সামনে সামনে হাটতে থাকে। যেতে যেতে হাটের মানুষের ভিড়ে মিশে যায় প্রতিবেশি যুবক। কৌশলে মিষ্টির হাড়ি নিয়ে সটকে পরে সে। ভায়রার ছেলের সাড়াশব্দ না পেয়ে অন্ধ লোকটি বার বার বলতে থাকেন,“ক্যারে বা আমি কার খালু”, “ক্যারে বা আমি কার খালু”, “ক্যারে বা আমি কার খালু ?”
প্রবন্ধে এ গল্প অবতারণার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা যদি নিজেদেরকে ঐ অন্ধ ব্যক্তির মতো ধুরন্ধর, পন্ডিত, অনেক শিক্ষিত হয়ে গেছি, জ্ঞানের উচ্চস্তরে পৌছে গেছি বলে মনে করে আর বই না পড়ি; লাইব্রেরীর যত্ন না নেই, লাইব্রেরী সংস্কারে মনোনিবেশ না করি তবে আমাদের পরিণতি ঐ অন্ধ ব্যাক্তির মতো হতে পারে।
(লেখক-সাংবাদিক, সভাপতি-প্রমথ চৌধুরী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, গীতিকার-বাংলাদেশ টেলিভিশন।)