আটঘরিয়ায় রহস্যজনক ভাবে বাঘ উধাও !

পায়েল হোসেন রিন্টু,ঈশ্বরদী ॥ আটঘরিয়ার মাজপাড়া ইউনিয়নের মন্ডল পাড়ার একটি বাঁশ ঝাড় থেকে মেছো বাঘ আটক,স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম কর্তৃক নিজ দায়িত্বে খাঁচা বন্দি মেছো বাঘটিকে বন বিভাগে জমা দেওয়ার জন্য আটককারীদের নিকট থেকে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার এক ঘন্টার মধ্যে ট্রাকের উপরে রাখা খাঁচা ভেঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার খবরে এলাকায় নানা প্রশ্ন ও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। বাঘ হারানোর ঘটনায় কেউ বলছেন,ট্রাক থেকে বাঘটি খাঁচা ভেঙ্গে পালিয়ে গেছে। কেউ বলছেন,ট্রাকের উপর দু’জন পাহারাদার থাকা অবস্থায় মজবুত রডের খাঁচা থেকে দু’পা ভাঙ্গা আহত বাঘ কোন ভাবেই পালাতে পারেনা,কেউ বলছেন ট্রাক থেকে খাঁচা ভেঙ্গে বাঘ পালালে এলাকার লোকজন জানতে পারতো,কেউ বলছেন, চেয়ারম্যান কর্তৃক আটকস্থান থেকে বাঘটিকে বন বিভাগের নিকট জনসম্মুখে হস্তান্তর না করে তড়িঘরি করে উপজেলা পরিষদ থেকে হস্তান্তরের কথা বলে নিয়ে যাওয়া এবং খবর পাওয়ার পরও অনেক সময় ক্ষেপন করে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পেছনে গুরুতর রহস্য রয়েছে। আবার কেউ বলছেন, পরিকল্পিতভাবে বাঘটিকে আটককারীদের নিকট থেকে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এলাকাবাসীর জানান,গত ১৮ জুন বৃহস্পতিবার ভোরে আটঘরিয়ার মাজপাড়া ইউনিয়নের মাজপাড়া মন্ডলপাড়া গ্রামের একটি বাঁশঝাড় থেকে আলহাজ¦ আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচটি পোষা কুকুর ও অর্ধশতাধিক এলাকাবাসীর সহায়তায় প্রায় দু’ঘন্টা চেষ্টার পর মেছো বাঘটিকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়। বাঘটি আটকের পরই এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক জনতার ভীড় জমতে থাকে। এ অবস্থায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আটঘরিয়ার থানার ওসি সাইফুল ইসলাম ও মাজপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মিয়াকে বাঘ আটকের বিষয়টি জানানো হলে তারা বন বিভাগের দায়িত্বশীলদের জানানো এবং তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্য বলেন। একইভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলামকেও একাধিক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে মেছো বাঘ আটকের বিষয়টি জানানো হয়। সংবাদ পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাঘটিকে একটি মাছবাহী ভাড়া ট্রাকে করে (ট্রাক নং-পাবনা-ন,১১-০১৪৩) নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঘটি ট্রাক থেকে পালিয়ে গেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে ট্রাকের উপর দু’জন পাহারাদারের উপস্থিতিতে বাঘটি ট্রাকের উপরে রাখা রডের খাঁচা থেকে পালিয়ে গেছে নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে তা নিয়ে এলাকায় নানা প্রশ্ন ও ধুম্্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় টিভিএম কলেজের অধ্যক্ষ শাহীনুজ্জামান মন্ডল বলেন, বৃহস্পতিবার ভোরে আফজাল হাজীর চিৎকার শুনে বাড়ির পাশেই আম বাগানে গিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে চারফুট লম্বা বাঘের মতো একটি মেছো বাঘ। এসময় গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষ ও পাঁচটি পোষা কুকুরের সহায়তায় প্রায় দু’ঘন্টা চেষ্টার পর বাঘটিকে আহত অবস্থায় আটক করে একটি রডের খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়। এর পর আটঘরিয়ার থানার ওসি সাইফুল ইসলামকে ফোন করলে তিনি বন বিভাগে ফোন করতে বলেন। সে মোতাবেক বন বিভাগে অনেকবার ফোন করে কোন রেসপন্স না পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর গফুর মিয়াকে ফোন করলে তিনিও একইভাবে বন বিভাগে ফোন করতে বললে আমরা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। এমতাবস্থায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আটঘরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম একটি ট্রাকসহ সরকারি জীপে ঘটনাস্থলে আসেন। আমরা মেছো বাঘটিকে বন বিভাগের কাছে জমা দেওয়ার জন্য তাকে প্রস্তাব দিলে উপজেলা চেয়ারম্যান নিজ দায়িত্বে উপজেলা পরিষদে নিয়ে বাঘটিকে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিকট জমা দেওয়ার কথা বলে বাঘের খাঁচা ট্রাকে তুলে নিয়ে যান। এর আগে চেয়ারম্যান কয়েকজনকে বাঘের সাথে ফটোশেষনও করেন। তিনি আরও বলেন,রাষ্ট্রীয় সম্পদ রাষ্ট্রের হেফাজতে থাকাই ভাল,তাই বাঘটিকে উদ্ধার করে বনবিভাগে সংরক্ষণ করা দরকার । তিনি রহস্যজনক ভাবে চলন্ত ট্রাক থেকে বাঘ হারানোর সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। বাঘ আটকের সাথে জড়িত একাধিক ব্যক্তি ও এলাকার প্রত্যক্ষদর্শিদের মধ্যে আলহাজ¦ আফজাল হোসেন’,ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মিয়া, ডিপ স্কীম ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন,ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান ও বিশ^ বিদ্যালয় ছাত্র মেহেদী হাসানসহ অনেকেই একইভাবে বাঘটিকে উদ্ধার করে বনবিভাগে সংরক্ষণ ও রহস্যজনক ভাবে বাঘ হারানোর রহস্য উদঘাটন ও সুষ্ঠ তদন্ত পূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দাবি করেন।
মেছো বাঘবাহী ট্রাক চালক ঠান্ডু বলেন, মাজপাড়া মন্ডল পাড়া থেকে ট্রাকের উপর লোহার খাঁচা বন্দি করে বাঘটিকে আমার ট্রাকের উপর তুলে নিয়ে উপজেলা পরিষদের দিকে যাচ্ছিলাম। এসময় দক্ষিণ নওদা পাড়া গ্রাম এলাকায় আসার পর বাঘটি খাঁচা থেকে বের হয়ে ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে চলে যায়। এসময় আমি ট্রাক চালাতে ছিলাম আর দু’ব্যাক্তি ট্রাকের উপর বাঘের পাহারায় ছিলেন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম তাঁর জীপ নিয়ে আমার ট্রাকের আগে আগে উপজেলা পরিষদের দিকে যাচ্ছিলেন। আমরা তখন অনেক মানুষের উপস্থিতিতে শত চেষ্টা করেও বাঘটিকে ধরতে পারিনি। বাঘটি নিকটস্থ কলাবাগানে চলে যায়। ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পথে দক্ষিণ নওদা পাড়া গ্রাম এলাকা থেকে মেছো বাঘটি ট্রাকে রাখা খাঁচা থেকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সঠিক না দাবি করে দক্ষিণ নওদা পাড়া গ্রামের ভ্যাটেনারী ডাক্তার সেকেšদার আলী,ইব্রাহিমের ছেলে এনামুল হক,ইদ্রিস আলীর ছেলে রায়হান,নির্মানাধীন বাড়ির রাজ মিস্ত্রী মসলেম,আব্দুর রহিম ও জলিলসহ অনেকেই জানান,বৃহস্পতিবার আমাদের এলাকায় ট্রাক থেকে মেছো বাঘ হারানোর কোন ঘটনা ঘটেনি। তবে বাঘবাহী ট্রাকটি চাঁদভা-আটঘরিয়া অভিমুখে যেতে দেখেছি। আমরা বাঘ পালানোর কোন খবরও জানিনা।
এ বিষয়ে আটঘরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বকুলসহ দু’ব্যক্তি আমাকে মেছো বাঘ আটকের বিষয়টি জানালে আমি সকাল নয়টায় আটঘরিয়ায় আসি। এরই মধ্যে বনবিভাগের ইসমাইল হোসেনের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন,এটা বন বিভাগে জমা দিতে হবে বা বনে ছেড়ে দিতে হবে। তখন আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্পটে হাজির হয়ে খাঁচার মধ্যে মরা টাইপের বাঘ দেখতে পাই। যার এক পা বাঁধা ও অন্য পায়ে আঘাত ছিল। আসলে সেটি ছিল ফিসিংক্যাট। তখন আমি আটককারীদের বলি ওটাকে হয় ছেড়ে দিতে হবে না হয় বনবিভাগে জমা দিতে হবে। তখন তারা বাঘটিকে নিয়ে বনবিভাগে জমা দিতে বললে আমি ওটাকে একটি মাছের ট্রাকে তুলে দিয়ে আগে চলে আসি। পরে ট্রাক চালকসহ ট্রাকে থাকা লোকজন আমাকে জানায় খাঁচা নরম ও দরজা শক্ত করে বাঁধা না থাকায় দক্ষিণ নওদা পাড়া নামক এলাকা থেকে বাঘটি পালিয়ে গেছে। আসলে বাঘ বিক্রি করা বা চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া কঠিন কাজ। রাজনীতি করি তাই একটি পক্ষ এটাকে নিয়েও রাজনীতি করছেন। তিনি অভিযোগ মিথ্যা বলে সঠিক ভাবে তদন্তেরও দাবি জানান।
একই বিষয়ে সামাজিক বনায়নের পাবনাস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বলেন, মেছো বাঘকে আটকের পর উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম নিজ দায়িত্বে আনছিলেন বলে শুনেছি। কিছুপথ আসার পর সেটি নাকি পালিয়ে গেছে। মেছো বাঘটি পালিয়ে গেছে নাকি ভেতরে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে, এমন প্রশ্নে বন কর্মকর্তা মাহাবুবর রহমান বলেন, “যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তদন্ত করে মূল ঘটনা অনুসন্ধান করা হবে।” কেউ যদি পোষার জন্য মেছো বাঘটিকে রাখে তাহলে উদ্ধার করা হবে। আবার কেউ যদি হত্যা করে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২০১২ সালের জীববৈচিত্র আইন অনুযায়ী বাঘটিকে উদ্ধারের জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ট্রাক চালক ও ট্রাকে থাকা অপর দু’জনসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃত রহস্য বের হয়ে আসবে বলে সচেতন মহল মনে করছেন।