চলে গেলেন “লিভিং ঈগল” খ্যাত কিংবদন্তি বিমান যোদ্ধা সাইফুল আযম

চোখে ঈগলের মতো তীক্ষ্ন দৃষ্টি। শত্রু পক্ষের বিমানের দিকে নির্ভুল নিশানা। বুকে অনন্ত দেশ প্রেম। আকাশের সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স বিশ্বের যে ২২ জন যোদ্ধাকে ‘লিভিং ইগলস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন তাদের অন্যতম ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অবঃ) সাইফুল আযম। জর্ডানের অর্ডার অব ইসতিকলাল, ইরাকের সাহসিকতা পদক নুত আল শুজাহ, পাকিস্তানের সামরিক পদক সিতারায়ে জুরাত প্রাপ্ত সাবেক এই গ্রুপ ক্যাপ্টেন আজ আমাদের মাঝে নেই। গত রবিবার ৭৯ বছর বয়সী কিংবদন্তি এ বিমান যোদ্ধা চির বিদায় নিয়েছেন। এ বীর বৈমানিক বিমান চালিয়েছেন জর্ডান, ইরাক, রাশিয়া, চীন পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র,ইংল্যান্ড এবং মাতৃভূমি বাংলাদেশের হয়ে। ২০১২ সালে পাকিস্তান সরকারের ভাষ্যমতে অন্য যে কোনো পাইলটের চেয়ে অধিক ইসরায়েলী বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডধারী সাইফুল আজম পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র যোদ্ধা, যিনি আকাশপথে লড়াই করেছেন তিনটি ভিন্ন দেশের বিমানবাহিনীর হয়ে।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে চারটি ইসরাইলি ভয়ঙ্কর জঙ্গী বিমান সুপারসনিক ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ মিশরীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর যখন জর্ডানের বিমান বাহিনীর উপর আক্রমনোদ্যত তখন তাদের প্রতিরোধে জর্ডানের একটি হকার হান্টারে পাইলটের আসনে বসেন অকুতোভয় বাঙালি যুবক পাইলট সাইফুল আযম। তখন তার পদবী ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মনেবলের দিক থেকে অতীব দৃঢ় শূণ্যের সম্মুখ সমরে জুড়ি হীন এ যোদ্ধার নির্ভুল নিশানায় ঘায়েল হন একাধিক ইসরাইলি সেনা। তিনি তৎক্ষনাৎ ভূপাতিত করেন একটি ইসরাইলি ‘সুপার মিস্টেরে’। আরেক আঘাতে আরেকটি জঙ্গী বিমান প্রায় অকেজো করে ফেলেন। সেটি পালিয়ে যায়, ইসরাইলি সীমানায়। অত্যাধুনিক ইসরাইলি বিমানগুলো হকার হান্টারের প্রতিরোধের মুখে পরে বিপর্যস্ত ও ব্যর্থ হয়। এ বীর বৈমানিকের সাথে কিছু কালের সান্নিধ্য লাভ ও একত্র পথ চলার সুযোগ হওয়ায় স্মৃতিচারণ ও দায়িত্ববোধ থেকে পাঠকের উদ্দেশ্যে আজকের এ লেখার অবতারণা।

কল্পনায় বিমান যুদ্ধের ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী মানিক দাস


পাবনার ফরিদপরের খাগড়বাড়িয়া গ্রামে ১৯৪১ সালে জন্ম নেন সাইফুল আজম। শৈশবের কিছু সময় কলকাতায় কাটানোর পর ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হওয়ার পর তার পরিবার বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) ফিরে আসেন। এখানে মাধ্যমিকের পড়া শেষে উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ালেখার উদ্দেশ্যে ১৪ বছর বয়সে তাকে পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দু’ বছর পর তিনি পাইলট অফিসার হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং জিডি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন।
মার্কিন সেনাদের প্রশিক্ষণ বিমান ‘সেসনা টি-৩৭’ এ সাইফুল আযমের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনার ‘লুক এয়ারফোর্স বেইস’ এ প্রশিক্ষণ নিতে যান তিনি। তুখোড় জঙ্গী বিমান ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ দিয়ে এ বিমানঘাঁটিতে তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে সাইফুল আযম পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঢাকাস্থ কেন্দ্রে যোগ দেন। তিনি করাচির মাশরুর বিমান ঘাঁটিতে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২ নম্বর স্কোয়াড্রনের ‘টি-৩৩’ বিমানের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য,এখানে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানকেও প্রশিক্ষণ দেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে সাইফুল আজম পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। এ যুদ্ধে জঙ্গী বিমান ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ নিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯ সেপ্টেম্বর সফল গ্রাউন্ড আক্রমনের পর ফেরার সময় প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হলেও সে যুদ্ধে সাইফুল আযম সঠিক নির্দেশনা দিয়ে আক্রান্ত করেন ভারতীয় ‘ফোল্যান্ড নেট’ নামক জঙ্গী বিমান কে। বিজয় মায়াদেব নামক ফ্লাইট অফিসারকে সে বিমান থেকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করা হয়। এ কৃতিত্বে উৎসাহ যোগাতে সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ‘সিতারা-ই-জুরাত’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
কিছু আরব দেশের অনুরোধে জর্ডান বিমান বাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে জর্ডানের বিমান বাহিনী ‘রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ার ফোর্স’ এ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সারওয়ার শাদ। ১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধে প্রচন্ড সামরিক শক্তির অধিকারী ইসরাইল আরব রাষ্ট্র মিশর, জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকের উপর আকাশপথে প্রচন্ড আক্রমণ চালালে মিশর ইসরাইল সীমান্তে সৈন্য পাঠালে ইসরাইলি বাহিনী মিশরের বিমান বাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জাম ধংস করে দেয়। সিরিয়ার বিমান বাহিনীর অর্ধেকের বেশি শক্তি ইসরাইলি বিমান সেনারা ধ্বংস করে। খুব অল্প সময়ে ইসরাইল গাজা এবং সিনাইয়ের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়। পশ্চিম তীর ও জেরুজালেম দখল করতে তাদের তেমন বেগ পেতে হয় নি। সিরিয়ার গোলান মালভূমিও দখল করে নেয় ইসরাইল। বাদশাহ হুসেইন জর্ডান নদীর তীর থেকে এবং গামাল আবদুল নাসের তার মনোবল হারানো বিপর্যস্ত বাহিনীকে সরিয়ে নেন সিনাই মালভূমি থেকে। সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশি থাকা সত্বেও বিপর্যস্ত আরব পক্ষ ইসরাইলের কাছে নতজানু, বিধ্বস্ত, দূর্বল হয়ে পরে। তারা যখন প্রচন্ড রকমের হতাশায় নিমজ্জিত এমন সময় সাইফুল আযম ইসরাইলের বিমান আক্রমণ প্রতিরোধে ৫ জুন জর্ডানের মাফরাক ঘাঁটি থেকে জর্ডানের অন্যান্য পাইলটদের সাথে নিয়ে চারটি ‘হকার হান্টার’ জঙ্গী বিমানের নেতৃত্ব দিয়ে আকাশে উড়েন এবং তিনটি ইসরাইলী বিমান ভূপাতিত করে পুরো পৃথিবীকে অবাক করেন। তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে মুহুর্মুহু আক্রমণে কিংকর্তব্য ও বিস্মিত হয়ে পরে ইসরাইলীরা। ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গী বিমান ভূপাতিত, দুইজন ইসরাইলি সেনা মারাত্মক আহত, অপর একটি সুপার মিস্টেরে বিমান প্রায় অকেজো হয়ে পরায় শক্ত প্রতিরোধের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হয় ইসরাইলের বৈমানিকেরা। এদিনের যুদ্ধের পর জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন সাইফুল আজমকে অভিনন্দন জানাতে ক্যাম্পে আসেন। সাইফুল আজমের কৃতিত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাদশাহ হুসেইন পরে তাকে ‘হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায় ভূষিত করেন।


এর দুদিন পরে ৭ জুন ১৯৬৭ সালে তিনি বার্তা পান ইরাকের বিমান বাহিনীর উপর ইসরাইলি বাহিনী হামলা করতে যাচ্ছে। এ হামলা প্রতিরোধ করতে জর্ডানের ঘাঁটি থেকে চারজন পাইলট প্রয়োজন। সাইফুল আজমকে নিতে হবে অধিনায়কের দায়িত্ব। আজমসহ কয়েকজন পাইলট অতি দ্রুত চলে যান পশ্চিম ইরাকে। ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ ও ‘আল-ওয়ালিদ’ ঘাঁটি রক্ষা করতে পাইলট ইহসান শার্দুমের সাথে আযমকেও দায়িত্ব দেয়া হয়। ইসরাইলের চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ ও দু’টি ‘মিরেজ থ্রিসি’ জঙ্গী বিমান আক্রমণ করতে আসে ইরাকের ‘এইচ-থ্রি বিমান ঘাঁটি। প্রথম থেকেই ইরাকি দল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোরে’র গুলিতে আজমের উইংম্যান নিহত হন । গিডিওন দ্রোরে দুটি ইরাকি বিমান ভূপাতিত করলে সাইফুল আজম আক্রমন চালান দ্রোরের ‘মিরেজ থ্রিসি’ এর উপরে। আঘাতে বিপর্যস্ত বিমানের ক্যাপ্টেন দ্রোর ধরা দেন, যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক হয়ে প্রাণে বাঁচেন। আযমের হকার হান্টারের কবলে পরে চারটি ‘ভেটোর’ বোমারু বিমানের একটি ধ্বংস হয়। সে বিমানটির ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গোলানও ধরা দেন। ইরাক আক্রমন করতে এসেও জর্ডানের মতো ব্যর্থ হয় ইসরাইলের বৈমানিক দল। জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্য মুক্তি পায় এ দুজন যুদ্ধ বন্দীর বিনিময়ে। সর্বোচ্চ তিনটি ইসরাইলি বিমান ধংস করায়, আকাশপথে যুদ্ধে নৈপুণ্যের স্বীকৃতি স্বরুপ দুঃসাহসী যোদ্ধা সাইফুল আযমকে ভূষিত করা হয় ‘নাত আল-সুজাহ’ সামরিক সম্মাননায়।
পাকিস্তানে ফিরে আসার পর ১৯৬৯ সালে ‘শেনিয়াং এফ-৬’ জঙ্গী বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হন সাইফুল আযম। আরো পরে ‘ফাইটার লিডারস স্কুল’ এর ফ্লাইট কমান্ডারের দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার চেষ্টা করলেও পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠিী তার সে চেষ্টা সফল হতে দেয় নি। তার দেশ প্রেম, জাতীয়তাবোধ ভয়ের কারণ হওয়ায় তার সাময়িক উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারী করে পাক সরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যেন যুদ্ধে অংশ নিতে না পারেন এজন্যই তাকে রুদ্ধ করে রাখে পাক সরকার। বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করার সময় তার সাথে আলাপ করেছিলেন মতিউর। ‘টি-৩৩’ জঙ্গী বিমান নিয়ে পালানোর সময় মতিউর শহীদ হলে পাক গোয়েন্দা সংস্থা সাইফুল আযমকে ২১ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। হয়তো খ্যাতিমান বিমান যোদ্ধা হওয়ার কারনেই তাকে হত্যা না করে স্বাধীনতার পর দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার হন। নিযুক্ত হন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক হিসেবে। তিনি বিমান বাহিনীর ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি ও ডিরেক্টর অব অপারেশনস এর দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে গৌরবময় কর্মকাল শেষ করেন। পরে তিনি দুই দফা সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান, এফডিসি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে পাবনা-৩ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শেষ জীবনে ‘নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সি’ নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন।
কিছু দিনের জন্য হলেও আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি অত্যন্ত মানবিক, সদালাপী এ মানুষটি জীবদ্দশায় যখনি গন মানুষের সাথে মিশেছেন তখনি তিনি নতুন প্রজন্মকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি সর্বদা মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করার আহবান জানাতেন। মহান আল্লাহ পাক যেন ওপারে তাকে ভাল রাখেন।
তথ্য সূত্র ঃ বাংলা উইকিপিডিয়া।
লেখকঃ সাংবাদিক, প্রভাষক মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজ।