করোনা কালের জীবন ধারায় মানুষ যখন অচেনা- অজানা মহামারিতে আক্রান্ত হবার ভয়ে দিশেহারা, জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান করে
দিনাতিপাত করছে, লকডাউন পালনের ফলে অনেকেই যখন স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি বা ঘরবন্দি, ঠিক তখনই আশাহত মানুষের মনে কিছুটা হলেও
নির্মল আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে পাবনার চাটমোহরের একদল যুবক, এক ফুট নয় দু ফুট নয় একেবারে ২২ফুট ঘুড়ি বানিয়ে শুধুমাত্র বাতাসের ওপর ভর
করে দুর আকাশে উড়িয়ে রীতিমত সাড়া জাগিয়েছে।
অপবাদ রয়েছে, বাঙালি নির্বোধের মত আচরণ করে। তারা সহজে কিছু মানতে চায়না। মহামারি করোনাকালে তারা শুধু লকডাউন
মানতেই একটু অনীহা প্রকাশ করে থাকে। তাছাড়া তাদের দোষ কোথায়? বরং তাদের উর্বর মস্তৃষ্কের কাছে অনেকেই হার মানতে বাধ্য হয়েছে।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সমগ্র বিশে^র রোগ তত্ববিদ বা রোগবিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন রোগ বিশয়ক পরামর্শক, ডাক্তার, কবিরাজ, কেমিষ্ট, ওঝা-বৈদ্য- ত্রান্ত্রিক, হাকিম, তাবিজ-কবজওয়ালা উস্তাদ-
সাগরেদগণ যখন এক ফোটা প্রতিষেধক আবিষ্কারে মহা ব্যস্ত তখন বাংলাদেশের ডাক্তারগণ আবিষ্কার করলেন যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত
ব্যক্তি সুস্থ্য হবার পর তার দেহ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করে আক্রান্ত রোগির দেহে তা প্লাজমা থেরাপি হিসেবে প্রয়োগ করলে ভালো ফল লাভ
করা যায়। যদিও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এটা করতে নিষেধ করেছে। শুধু তাই নয়, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের এক সময়কার মেধাবি ছাত্র
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিজ্ঞানী বিজনশীল অতি অল্পসময়ের ব্যবধানেকরোনাভাইরাস ত্বরিত সনাক্তের জন্য কীট আবিষ্কার করে বিশ^ব্যাপি সাড়া জাগিয়েছেন।
বাংলাদেশের পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও যশোরের স্বল্প শিক্ষিত মেকানিক্সগণ দেশের যানবাহনের চাহিদা মেটাতে তৈরি করলেন রিকসা ভ্যান, মালবাহি
ভ্যান, নছিমন, করিমন, আলম সাধু, লেটা হ্যাম্পার এমনকি কুত্তা গাড়ি নামের একটি মাটি টানা গাড়িও তারা আবিষ্কার করে ফেলেছে।
মালামাল পরিবহন ও যাত্রি পরিবহনে এ যেন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শুধু কি তাই, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়নের সাবেক
চেয়ারম্যান মন্তাজ আলী চতুর ওরফে চতুর আলী, আশির দশকে একটি উড়োজাহাজ আবিষ্কার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তার
বিদ্যার দৌড় অষ্টম শ্রেনী হলেও তার বুদ্ধিমত্তার তারিফ করে সেসময় তাকে সকলেই বাহবা দিয়েছিলো। তার সেই প্রস্তাবিত উড়োজাহাজটি
আকাশে যেমন ডানা মেলে উড়তো, তেমনি পানিতেও ভেসে বেড়াতে পারতো। কিন্তু বিশেষ কোন কারণে সেটা তিনি আর শেষ করতে
পারেননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা চতুর আলী উড়োজাহাজ আবিষ্কার অসমাপ্ত রেখেই মারা যান। পরে তার ছোট ভাই আমিনুল মেকানিক্স সেই উড়োজাহাজের পার্স-পাতি ভাংড়ি হিসেবে সের দরে বিক্ত্রি করেছিলেন বলে জানা যায়।
ইদানিংকালে বহুল প্রচারিত অনলাইন পত্রিকা ‘‘অনাবিল ডট নেট’’ এ প্রকাশিত হয়েছে একটি খবর। তা হলো চাটমোহরের কাটাখালি
গ্রামের আনিছুর রহমান নিজ হাতে ২২ ফুট দীর্ঘ বৃহৎ আকারের একটি ঘুড়ি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে রীতিমত হৈ- চৈ ফেলে দিয়েছেন। ঘুড়ির নাম দিয়েছেন রকেট ঘুড়ি। সেই ঘুড়ি তৈরিতে
উৎসাহ যুগিয়েছেন ডিবিগ্রাম ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ। কারুকার্যে মজিবর রহমান, সেন্টু, রফিজ উদ্দিন, আসাদুজ্জামান ও সিহাব উদ্দিনসহ কয়েক সহপাঠি মিলে ঘুড়িটি
তৈরি করেছেন। ঘুড়িটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার টাকা।
প্রায় ২০ কেজি ওজনের এই ঘুড়িটি ১০ জন মিলে ধরাধরি করে আকাশে ভাসিয়ে দিয়ে এলাকার মানুষকে অনাবিল আনন্দ দান করেছেন তারা।
বর্তমানে করোনাকালে দেশের যুব-সমাজ নতুন করে বেকার হতে বসেছে। সরকারি -বেসরকারি চাকরির সকল দুয়ার এখন অনির্দিষ্ট কালের
জন্য বন্ধ। তারা গভীর হতাশায় নিমজ্জিত। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সকল বিদ্যাপীঠ ডেডলক বা লকডাউন ঘোষণা করা আছে। আবার কবে আগের
মত বই-খাতা আর টিফিন বক্সের ভারি ব্যাগ পীঠে বা কাঁধে ঝুলিয়ে তারা আপন আপন বিদ্যাপীঠে গিয়ে নিস্তব্ধ অংগন গুলো কোলাহল মুখর
করে তুলবে তা কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারেনা।
এই করোনা কালে, মোবাইল ফোনে ফেস বুক, ম্যাসেনজারসহ নানাবিধ অ্যাপস টিপাটিপিতে যারা অভ্যস্ত তারা শুধু ওয়াই ফাই এর
মালিককে ধনী বানিয়ে এবং জিবি -এমবি কিনে নিজের গার্জিয়ানদেরকে ফতুর করতে যখন ব্যস্ত ঠিক তখুনি কাটাখালি গ্রামসহ আশেপাশের এলাকার ছাত্র ও যুবসমাজ তথা সকল শ্রেণি-পেষার মানুষকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও উন্মুক্ত আকাশ পানে চেয়ে বুক ভরে নির্মল বায়ূ সেবন করার সুযোগ করে দিয়েছেন তারা।
প্রকৃতপক্ষে আকাশে ঘুড়ি উড়ানো একটি দারুন আনন্দের বিষয়।
ছোটবেলায় হাতে লাটাই ধরে ঘুড়ি উড়ায়নি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। কবি সুফিয়া কামাল ঘুড়ি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘আমরা যখন আকাশের তলে উড়িয়েছি শুধু ঘুড়ি/ তোমরা এখন কলের লাঙল চালাও গগন জুড়ি।’’
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুড়ি উড়ানোর প্রচলন রয়েছে। প্রায় ২ হাজার ৮ শ বছর আগে চীন দেশে সর্বপ্রথম ঘুড়ি উড়ানোর প্রচলন শুরু হয়।
আজকে সারা বিশে^ চীন যেমন করোনাভাইরাসের আঁতুর ঘর। তেমনি ঘুড়ি উড়ানোর ক্ষেত্রে ও তারা মুরুব্বী বলতেই হয়। বিশ^ জুড়ে ঘুড়ি উড়ানো একটি মজার খেলা। এটি এশিয়ার অন্যান্য দেশ-বাংলাদেশ, ভারত, কোরিয়া ও জাপানে বহুল প্রচলিত। এছাড়া ইউরোপে ঘুড়ি খেলাটির প্রচলন ঘটে প্রায় ১ হাজার ৬ শ বছর আগে থেকে। প্রথম দিকে ঘুড়ি
কাগজ অথবা হাল্কা তন্তুজাতীয় সিল্কের কাপড় দিয়ে উড়ানো হতো।
ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানের অংশ হিসেবে ঘুড়িতে বাঁশের কঞ্চি কিংবা অন্যান্য শক্ত অথচ নমনীয় কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়।
প্রতিবছর ভারতের পশ্চিামঞ্চল আহমাদাবাদ শহরে জাকজমক ভাবে আয়োজন করা হয় আন্তার্জাতিক ঘুড়ি উৎসব। এই অনুষ্ঠান চলে সাতদিন
ব্যাপি। গত বছর ৩১ টি দেশ থেকে আসা নানা বয়সি মানুষ বিভিন্ন নকশার ১শ ৮০ টি ঘুড়ি নিয়ে হাজির হন এই ঘুড়ি উৎসবে।
সুর্যদোয়ের দেশ জাপানের মানুষ অতীতে নাকি ঘুড়ি উড়ানোর নেশায় এমনি বুঁদ হয়ে থাকতো যে, কোন কাজই তারা করতোনা। ফলে জাপানে
ঘুড়ি উড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। কিন্তু এখন জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
জাপানের ঘুড়ি উৎসবকে বলা হয়‘‘হামামাতসু
মাতাসুরি।’’বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের ঘুড়ির প্রচলন রয়েছে। অঞ্চল ভেদে ঘুড়ির নামও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ঘুড়ির প্রচলিত নামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন
ঘুড়ি, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, বেঙ, মৌমাছি, কামরাঙা, আগুন পাখি, প্যাঁচা, ফিনিক্স, চরকি লেজ ঘুড়ি, মানুষ
ঘুড়ি, তারা ঘুড়ি, পালতোলা জাহাজ ঘুড়ি, জাতীয় পতাকা ঘুড়ি।
এছাড়া আরো রয়েছে ঢাউসও চিল ঘুড়ি।
ইদানিং কালে বাঙালির বুদ্ধিমত্তায় আলোর ঘুড়ির প্রচলন শুরু হয়েছে।
ঘুড়িতে মোবাইলের ব্যাটারি সংযোজন করে টুনি বাতি বা মরিচ বাতির আলো জ¦ালিয়ে বিভিন্ন আকৃতির ঘুড়ি রাতের বেলা আকাশে
উড়ানো হয়। করোনাকালে রাতের আকাশে আলোর ঘুড়ি উড়িয়ে গভীর রাত পযর্šÍ এলাকার মানুষজনকে আনন্দ দান করছে এক শ্রেণির যুবকেরা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।
বলতে গেলে সমগ্র দেশই বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। সেসময় প্রশিক্ষণ শেষে ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর গেরিলা হামলা করার জন্য বৃহৎ আকারের ৬ দাঁড়ের নৌকা বরাদ্দ দেয়। সেই সকল নৌকায় পাল তোলা এবং গুণ টানার ও ব্যবস্থা ছিলো। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের যাতায়াতের জন্য সকল ধরণের যানবাহন থাকলেও তাদের চলাচলের জন্য কোন নৌকার ব্যবস্থা ছিলোনা।
নদী কিংবা পাঁথার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা যখন নৌকায় দোঘুন্টি অথবা তিনঘুন্টি পাল তুলে বাতাসে ভর করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে
অদৃশ্য হয়ে যেতো তখন তারা রাজাকারদেরকে বলতো এ কেয়া বাত হায়?
মুক্তি কেয়ছা ভাগ গেয়া? রাজাকাররা বলতো হুজুর ওরা বাতাসে নায়ের বাদাম তুলে ভেগে গেছে। বাদাম কেয়া হায়? রাজাকাররা বোঝাতো ওরা
বাতাসে ভর করে ভেগেছে। পাকিস্তানি আর্মিরা বলতো ‘‘ ইয়ে আজিব বাত হায়, শালে লোগ হাওয়া পাকাড় কর ভাগতা হায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিফৌজরা বাতাসে ভর করে ভেগে যেতো আর বর্তমানের করোনাকালের যুদ্ধে এখনকার করোনা যোদ্ধারা সেই বাতাসে ঘুড়িয়ে
উড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আনন্দ দান করে চলেছে। বিশেষ করে চাটমোহরের কাটাখালি গ্রামের যুবকেরা। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক
ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১