এবারে বিশ^জুড়ে করোনা মহামারির মধ্য দিয়েই হয়ে গেলো ঈদুল ফিতরের ঈদ। শুধু কি তাই? রমজানের শেষের দিকে ঈদের মাত্র কদিন আগে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে স্মরণকালের ভয়াবহ সুপার সাইক্লোন আমফান আঘাত হানে বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৪ টি জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েটি জেলায় প্রলয়ংকারি ঘুর্ণিঝড় আমফানের আঘাতে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
১৫ মে-২০২০ তারিখে আবহাওয়া দপ্তর থেকে ‘আমফান’ নামক একটি সুপার সাইক্লোন বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়। এমনিতেই করোনাভাইরাসের নিদারুন জ¦ালা তার উপর সুপার সাইক্লোন আমফানের আগমণি বার্তায় সাগর কুলের বাসিন্দারা দিশেহারা। আমফান ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সরকারি প্রস্তুতি চলতে থাকে পুরোদমে। ১৯ মে রাত ১১টার দিকে ৬ নং বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। সরকার ইতোমধ্যে উপকুলবাসিকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার জন্য ১২ হাজারেরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে ১৪ জেলার জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্র যাবার জন্য আহবান জানায়। পরদিন সত্যি সত্যিই শক্তিশালি ঘূর্ণিঝড় আমফান ভারতের পশ্চিম বঙ্গ এবং বাংলাদেশের উপকুলবর্তী এবং পাশ^বর্তী জেলা সমুহের উপর দিয়ে বয়ে যায়। সাথে জলোচ্ছাস। সারা দেশব্যাপি করোনা দুর্যোগের মধ্যে আমফান আরেক দুর্যোগ। বোঝার উপর যেন শাকের আটি।
একদিকে সামাজিক দুরত্ব মানতে হবে, অপর দিকে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হবে। এমনি ত্রিসংকুল অবস্থা। বর্তমান সরকার করোনা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে গিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছিলো তখন আরেক দুযোগের থাবা যাতে বিস্তার করতে না পারে এবং উকুলীয় অধিবাসীদের যাতে প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য সরকারের বিভিন্ন প্রশাসন রাতের ঘুম হারাম করে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করেন। তিনি সারাক্ষণ খোজ-খবর রাখেন ঘুর্ণিঝড় আমফানের।
করোনাভাইরাস মহামারি রোধের অংশ হিসেবে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা অতীতের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, এবার ২২ লাখ মানুষের জন্য ১২ হাজার ৭৮ টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে বলে তিনি জানান। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মানুষজনকে সাইক্লোন সেন্টারে নেওয়ার সময় সামাজিক দুরত্ব রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ১০ ধরণের শুকনা খাবার, পানি, সাবান, মাস্ক,শিশুখাদ্য, গবাদিপশুর খাদ্য ইত্যাদি নিশ্চিত করা হয়েছে।
বর্তমানে বিশ^ব্যাপি মহামারি করোনাভাইরাসের আক্রমণের মত দুভিক্ষ,মঙ্গা,ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস বাংলাদেশের মানুষের নিকট অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে বলতে হয়। সাবেক পুর্ব-পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এদেশের মানুষ কতবার যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করেছে তার ইয়ত্বা নেই। ইতিহাস সাক্ষ দেয় ১৯৬৫ সালের ১৪-১৫ ডিসেম্বরে বঙ্গপ সাগর উপকুলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস আঘাত হানলে ৮শ২৩ জন মানুষ এবং সেই সাথে বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু ও অন্যান্য জীবজন্তু মারা যায়। ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধনসহ ৪০ হাজার লবন খামার নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৬৬ সালের ১ অক্টোবর সন্দীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্রগ্রাম এবং কুমিল্লার উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস বয়ে যায়। এসময় সর্বোচ্য বাতাসের গতিবেগ ছিলো ১শ ৪৬ কিলোমিটার। এতে ১.৫ মিলিয়ন ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ৮শ৫০ জনের প্রাণহানি ঘটে। প্রায় ৬৫ হাজার গবাদি পশু মারা যায়।
১৯৭০ সালে ভয়াবহ ঘূণিঝড়ের কথা কার না মনে আছে? সমগ্র বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চল (তৎকালিন পুর্ব-পাকস্তান) চট্রগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালি, চরবোরহানউদ্দিনের উত্তর পাশ, চর তাজুমদ্দিন, চর মাইজদি এবং হরিণঘাটার দক্ষিণ পাশ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ি মৃতের সংখ্যা ৫ লক্ষ, কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি ধারণা করা হয়। ক্ষতির মধ্যে ১০ লক্ষ গবাদিপশুর মৃত্যু, ৪ লক্ষ ঘর-বাড়ি এবং ৩ হাজার ৫ শ শিক্ষাকেন্দ্র বিধ্বস্থ হয়। কয়েক হাজার মাছধরা নৌকার কোন খোঁজ পাওয়া যায়না। এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিলো ঘন্টায় ২শ ২২ কিলোমিটার এবং জোয়ারের উচ্চতা ১০.৬ মিটার।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো তা এই করোনাকালের জীবনধারায় সে ইতিহাসকেও বার বার নাড়া দেয়। এখন যেমন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ^ দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার নানা পন্থা-পথ আবিষ্কার করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন, ঠিক তখনো বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের উন্নয়ন তথা এদেশের মানুষের ভাগ্যন্নোয়নে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তখন ষড়যন্ত্রের জাল চারিদিক থেকে অক্টাপাশের মতো তাকে ঘিরে ধরে। স্বাধীনতার স্বাদ ভোগের বদলে এদেশের মানুষের জীবন ক্ষুধায় কাতর। ঠিক সেই সময়কার কবি রফিক আজাদ তার কবিতায় উনুনে যেন ঘি ঢেলে দিলেন। তিনি তার কবিতায় বাংলার মানুষকে উষ্কে দেন যেমন,“ ….. উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্য মন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী/ আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ/ ভাত দে হারামজাদা/ তা নাহলে মানচিত্র খাবো।” যতদুর জানা যায় কবি রফিক আজাদ ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেসময়কার কবিতায় তিনি কাকে গালি দিয়েছিলেন? এইসব বর্ণচোরারা এখনো আমাদের সমাজে ঘাপটি মেরে আছে। তারা সুযোগ পেলেই পরিস্থিতি বুঝে কচ্ছপের মত মুখ বের করে সরকারকে ফাঁসানোর বৃথা চেষ্টা করে থাকে। এমনি ঘটনার অবতারণা হয়েছে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায়। ঘটনাটি ঘটেছে খুলনার কয়রা উপজেলার ২ নম্বর কয়রা গ্রামে। জামায়াত নেতাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।