করোনা কালের জীবন ধারা- ১০

করোনভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর আক্রমণ থেকে শতর্কতার জন্য সৌদি আরবে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হতে হজ ও ওমরাহের ভিসা স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি পবিত্র ক‘াবা প্রাঙ্গনে তাওয়াফ স্থগিত করা হয়েছে।


নবম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার পর থেকে ইসলামের ইতিহাসে নানা সময়ে হজ ও ওমরাহ বন্ধ ছিলো। যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মহামারির প্রাদুর্ভাব, বৈরি আবহাওয়াসহ নানাবিধ কারণে অনেকবার এধরনের ঘটনা ঘটেছে। হস্তিবর্ষে আবরাহার আক্রমণের ফলে কাবা প্রাঙ্গনে আরব ভুখন্ডের মানুষের চিরাচরিত প্রথা কাবার তাওয়াফ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকে।
৫৭০ খিষ্টাব্দের ভিতরে এ ঘটনাটি ঘটেছিলো। এ বছরই মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া হজরতের নবুয়তের পাঁচ বছর আগে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কাবা ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে কোরাইশরা কাবা পুনর্নিমাণের সিদ্ধান্ত নেয়। আর তখন কাবার তাওয়াফ বন্ধ থাকতে পারে। যেহেতু তাতে দীর্ঘ সময় লেগেছিলো। রাসুল (সা.) এর মাধ্যমে হাজরেআসওয়াত স্থাপনের ঘটনা এসময় ঘটেছিলো। এমন আরো বিবিধ কারণে কাবার হজ ও তাওয়াফ বন্ধ ছিলো। অপর দিকে মদনিাতুল মনোওয়ারায় হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) কর্তৃক নির্মিত মসজিদে নববী ও বিভিন্ন সময়ে বন্ধ অবস্থায় থাকে।
এবারে বিশ^ ব্যাপি করোনাভাইরাসের আক্রমণের মধ্যেই পবিত্র রমজান মাস এসে গেলো। পবিত্র রমজান মাসে এশা নামাজের পর তারাবি নামাজ আদায়ের বিধান রয়েছে। এমননিতো এদেশে তারাবি নামাজ আদায়ের রাকায়াত নিয়ে আলেম-উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এক শ্রেণির আলেমের মতে তারাবি এর নামাজ ৮ রাকায়াত। কিন্তু আহলে সুন্নাতওয়াল জামাতের মতাদর্শ আলেম-উলামাদের মতে তারাবি এর নামাজ ২০ রাকায়াত। তবে বাংলাদেশে ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায়ের মুসুল্লি সংখ্যাই বেশি। ইসলামের ইতিহাসে মাসলা-মাসায়েল নিয়ে বিতর্ক আজ নতুন নয়। সুদীর্ঘকাল ধরেই এটা চলে আসছে।
ওয়াক্তিয়া নামাজের জামায়াত, জুমা নামাজের জাময়াতের জন্য দিক নির্দেশনার মত তারাবি এর নামাজে মুসুল্লি সংখ্যা কতজন হবে তা ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে এর সংখ্যা হবে মাত্র ১২ জন। প্রচলিত ধারা হিসেবে পবিত্র রমজান মাসে সারাদিন রোজা পালন শেষে রাতে এশা নামাজের পর মসজিদগুলোতে ২ ধরণের তারাবিহ নামাজ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ওয়াক্তিয়া তারাবি ও খতম তারাবিহ। খতম তারাবি নামাজ আদায় করতে প্রত্যেক মসজিদে ইমাম হিসেবে ২ জন হাফেজ থাকেন। তারা সারা মাস নামাজের মধ্যে পবিত্র কোরআন খতম করেন। এসময় হাফেজগণ মোটা অংকের হাদিয়া লাভ করে থাকেন। কিন্তু এবারে তা হবার নয়। এই হাদিয়া দ¦ারা অনেক হাফেজ সাহেবেরই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়ে থাকে।


এমনিতেই আমাদের দেশে মসজিদমুখি মুসুল্লি বা নামাজির সংখ্যা কম। অনেক ওয়াজ নসিহত করে বেহেশত- দোজখের কথা বলে তাদেরকে মসজিদমুখি করা হয়। দেশের বেশিরভাগ মসজিদই এলাকার মুসুল্লিদের দানের উপর নির্ভর করে চলে। যদিও মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতন খুবই নগন্ন। তাও আবার বাকি –বকেয়াই বেশি। প্রায় মসজিদের নামাজের কাতারের একপাশে টিনের কৌটা বা ছোট বাক্স রাখা হয়। ওয়াক্তিয়া ও জুম‘া নামাজের সময় ফরজ নামাজের জাময়াত শেষে কৌটা চালু করা হয়। মুসুল্লিরা এতে বেশিরভাগ ক্ষেতেই ছেঁড়া-ময়লা, প্রায় অচল নোট কৌটায় দান করে অন্যদের দিকে ঠেলে দেয়। এসময় নামাজের জা‘মায়াত শেষে ইমাম সাহেব চুপচাপ বসে থাকেন। কৌটা চালানের খস্খস্ শব্দ থেমে গেলে তিনি মোনাজাত শুরু করেন।এবারে করোনা ভয়ে মসজিদে যাওয়া মাফ তাই হয়তোবা দানও মাফ। বাংলাদেমের বেশিরভাগ মসজিদের ই এমন অবস্থা। বিষয়টি তাই সংশ্লিষ্ট সকলকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে বৈকি?
বিশ^ব্যাপি করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রমণের মধ্যে ঝুঁকি এড়াতে আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে ৫ জনের বেশি ওয়াক্তিয়া নামাজ, ১০ জনের বেশি জুম‘ার নামাজ এবং ১২ জনের বেশি তারাবিহের নামাজ আদায় করা যাবেনা মর্মে সরকার হতে আদেশ জারি করা হয়েছে। এনিয়ে অনেক মসজিদের মুসুল্লিদের মাঝে তর্ক-বিতর্ক ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৩ এপ্রিল, গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলার বাটিকামারি ইউনিয়নের বাহাড়া পশ্চিমপাড়া গ্রামে নামাজ আদায়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে সুজন সেখ (২৬) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন এবং ২৭ ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
কাশিয়ানি ও মকসুদপুর সার্কেলের এএসপি আনোয়ার হোসেন ভুঁয়া জানান, মসজিদে ৫ জনের বেশি নামাজ পড়া যাবেনা বলে গ্রামের বিবাদমান দুটি পক্ষের মধ্যে এশা নামাজের সময় তর্ক-বিতর্ক হয়। পরদিন এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ঘটে। পাবনা সদর উপজেলার টিকুরী গ্রামে গত ২৮ এপ্রিল, তারাবি নামাজ আদায়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের জের ধরে বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে। করোনা কালে সরকারের নিষেধ অমান্য করে টিকুরি পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের কমিটি ও স্থানীয় মুসুল্লিদের মাঝে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সংঘর্ষ বাধে। এঘটনায় কয়েকজন আহত হয়।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।