ভরসা শব্দটির আরবি তাওয়াককুলের বাংলা। নির্ভর করা বা কোন অবলম্বন গ্রহণ করা অর্থে ব্যবহৃত হয়। মুসলিম মানসে তাওয়াককুল শব্দটি মূলত আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভর করা অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে, কারণ ‘মুমিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা’ (আল-মুজাদালাহ : ১০) । ইমাম গাজালি তাওয়াককুলকে দীনের সুউচ্চ স্থান ও আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দাদের অনন্য সম্মান হিসেবে অভিহিত করেছেন, ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম তাওয়াককুলকে দীনের অর্ধেক বলে গুরুত্বারোপ করেছেন। আল্লাহর উপর নির্ভরতার সঠিক ধারনা নিয়ে অনেক মুসলিমদের মাঝে নানাধরনের বিভ্রান্তিমূলক চিন্তা পরিলক্ষিত হয়, করোনা ভাইরাসের মহামারীর সময়ে যেটি ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
নির্ভরতা মূলত পাঁচটি মানদণ্ডের সমন্বয়; এক-জাগতিক অবলম্বনের আশ্রয় গ্রহণ করা, দুই- অন্তরকে আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি স্থিত করা, তিন-আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদেয় ভাগ্য ও সিদ্ধান্তের প্রতি প্রশান্ত থাকা, চার-ইতিবাচক ফলাফলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ও পাঁচ- নেতিবাচক ফলাফলে ধৈরয ধারণ করা।
আল্লাহর উপর ভরসার প্রাথমিক ধাপটি মূলত সতর্কতামূলক, প্রস্তুতি মূলক, কাজ সম্পাদন করার পূর্ব পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ। সে কাজটি হতে পারে কোন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ পূর্ববর্তী পদক্ষেপ কিংবা নেতিবাচক ফলাফল থেকে নিরাপদ থাকার পূর্ববর্তী সতর্কতা । যেমন, বিবাহ সংক্রান্ত একটি হাদিসে রাসূল (স:) বিয়ের পূর্বে বর-কনের সৌন্দর্যে, দীন, বংশ পরিচিতি এবং সম্পদের সামঞ্জস্যতার বিষয়গুলোকে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গুরুত্ব দিতে বলেছেন । যদিও এখানে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিবাহ সম্পাদনের মাধ্যমে একটা পবিত্র বন্ধনের সূচনা করা এবং পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করা, কিন্তু কোন প্রাথমিক অপরিপূর্ণতার কারণে বিয়ে পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রী কিংবা দুই পরিবারের মাঝে সম্ভাব্য যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যই বিয়ের আগে পূর্ব-সতর্কতা হিসেবে বর-কনের সামঞ্জস্যতার বিষয়টিতে ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করে। অন্যদিকে, আদম ও হাওয়াকে (আ:) জান্নাত থেকে বের হয়ে যাওয়ার মত নেতিবাচক পরিণতি থেকে রক্ষা করার পূর্ব-সতর্কতা হিসেবে আল্লাহ তাদেরকে একটি গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন, “তোমরা এই গাছটির নিকটবর্তী হয়োনা, না হয় তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে” (বাক্বারা: ৩৫) । পূর্ব সতর্কতার ব্যাপারে অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ সরাসরি আমাদেরকে আদেশ দিয়ে বলছেন, “হে মুমিনগণ তোমরা সতর্কতা অবলম্বন কর” (নিসা : ৭১ )। আল্লাহর উপর নির্ভরতার দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে মূল কাজ সম্পাদন করা বা নেতিবাচক কাজের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সরাসরি সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেমন, বর-কনের অবস্থানগত সামঞ্জস্যতা পাওয়া গেলে বিবাহের কাজ সম্পাদন করা, কিংবা অসুস্থতার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা; যেহেতু রোগ থেকে মুক্ত হওয়ার জাগতিক সম্ভাব্য পদক্ষেপ হল চিকিৎসা গ্রহণ করা, “আল্লাহ তায়ালা এমন কোন রোগ দেননি, যার কোন চিকিৎসা নাই” (বুখারী : চিকিৎসা অধ্যায়)। আল্লাহর উপর নির্ভরতার তৃতীয় ধাপ হচ্ছে চূড়ান্ত পদক্ষেপ, যেটি দ্বারা একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করাকেই বুঝানো হয়েছে । বান্দা তার সক্ষমতা ও জাগতিক মাধ্যম সমূহ অবলম্বন করে কর্ম সম্পাদনের পর সেটার ভালো মন্দের ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে আল্লাহর উপর নির্ভর করবে। আল্লাহ যা ভালো মনে করবেন সে অনুযায়ী তার ফলাফল নির্ধারণ করবেন বলে আন্তরিক ধারণা পোষণ করবে, কেননা জাগতিক মাধ্যম সমূহ গ্রহণ করার পর বান্দার করার আর তেমন কিছুই থাকেনা। তাই বান্দা তার পরবর্তী ভালো মন্দের জন্য আল্লাহর উপরই চূড়ান্ত নির্ভরতা প্রদর্শন করবে । “আর যে আল্লাহর উপর নির্ভর করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান” (আত্ব-তালাক : ৩) ।
যেহেতু আল্লাহর উপর ভরসার একটি ধাপ অন্য আর একটি ধাপের পরিপূরক সেক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি নির্ভরতার ক্ষেত্রে উপরের তিনটি ধাপই প্রয়োগ করবে । যেমন, কেউ যদি সন্তান প্রত্যাশা করে তাহলে তাকে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে প্রথম ধাপে উপযুক্ত পাত্র/পাত্রী খুঁজে বের করতে হবে, দ্বিতীয় ধাপে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং স্বামী-স্ত্রী পারষ্পরিক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং তৃতীয় ধাপ বা চূড়ান্তভাবে সন্তান প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর নির্ভর করবেন। একইভাবে প্রত্যেকের রিজিক আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং বণ্ঠনকৃত এই ধারনার উপর ভিত্তি করে আল্লাহর উপর নির্ভরতার অজুহাতে রিজিকের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে বরং রিজিক প্রাপ্তির জন্য ব্যবসা, চাকরি কিংবা অন্যান্য অবলম্বনের আশ্রয়গ্রহণ করে তার ভালো মন্দের জন্য আল্লাহর উপর চূড়ান্ত ভরসা করবে, “সালাত সমাপ্ত হইলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়িবে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করিবে ” (জুমআ’ : ১০) ।
অন্যদিকে আল্লাহর উপর নির্ভরতা ব্যতিরেকে শুধু জাগতিক অবলম্বনের উপর নির্ভর করা মূলত জাহেলী ধারনা যেটি আমরা রাসূল (স:) এর একটি হাদিস দ্বারা বুঝতে পারি যেখানে তিনি বলেছেন ‘ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নাই” (বুখারী : কিতাবুত তিব্ব, ৫৭১৭ )। মক্কার জাহেলী সমাজের লোকেরা সংক্রমণ রোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুধুমাত্র রোগটি ছোঁয়াচে কিনা সেটার উপর নির্ভর করতো, অথচ রোগ ছোঁয়াচে হলেও সংক্রমণ করার ক্ষমতা থাকা বা না থাকা পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর উপর নির্ভর করে তা তারা অস্বীকার করতো। এ ধরনের নির্ভরতাকে আল্লাহ ভৎসনা করেছেন; হুনাইনের যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা শত্রুপক্ষের চেয়ে তুলনামূলক বেশী হওয়ায় শুধুমাত্র সংখ্যাধিক্যের উপর ভিত্তি করে মুসলিম সৈন্যরা বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ধারনা পোষণ করলো এবং আত্মতৃপ্তিতে লিপ্ত হল, পরিণতিতে প্রাথমিকভাবে মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হলো, এবং হুনাইনের যুদ্ধের দিনে যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করিয়াছিল তোমাদের সংখ্যাদিক্য; কিন্তু উহা তোমাদের কোন কাজে আসে নাই এবং বিস্তৃত হওয়া সত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হইয়াছিল, পরে তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া পলায়ন করিয়াছিলে” (তাওবাহ : ২৫)। এ জন্যেই রাসূল (স:) উট ছেড়ে দিয়ে নয় বরং তাকে গাছের সাথে বেঁধে তারপর আল্লাহর উপর নির্ভর করতে বলেছেন।
আল্লাহর উপর নির্ভরতার ধাপসমুহ প্রায়োগিকতার ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার সেটি হলো, যদি পরিস্থিতি কখনো এমন হয়, যখন কোন সম্ভাব্য জাগতিক অবলম্বন থাকেনা কিংবা অবলম্বন গ্রহণ করাও সম্ভব হয়ে উঠেনা সে ক্ষেত্রে নির্ভরতার ধাপসমুহের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সম্ভব হবে? এ ক্ষেত্রে মুসলিমদেরকে চূড়ান্ত বা তৃতীয় ধাপের নির্ভরতার আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে, কারণ নির্ভরতার চূড়ান্ত স্বত্বা মূলত আল্লাহ তায়ালা। এ ক্ষেত্রে ইব্রাহীমকে (আ:) আগুনে নিক্ষেপ করার ঘটনাটি আমরা বিবেচনায় আনতে পারি, যেখানে আগুন থেকে বাঁচার জন্য ইব্রাহীম (আ:) এর কাছে আল্লাহর উপর তাওয়াককুল করা ব্যতিরেকে আর কোন জাগতিক অবলম্বন ছিলোনা, যার কারনে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরেও আল্লাহর উপর অগাধ তাওয়াককুলের কারনে তিনি আগুনের অনিষ্টটা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন “উহারা বলিল, তাহাকে পোড়াইয়া দাও, সাহায্য কর তোমাদের দেবতাগুলিকে, তোমরা যদি কিছু করিতে চাও”; “ আমি বলিলাম, হে অগ্নি! তুমি ইব্রাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হইয়া যাও” (আম্বিয়া : ৬৮ ও ৬৯ ) ।
ইউনূছ (আ:) ক্ষেত্রে তিমির পেটে থাকা অবস্থায় বাঁচার জন্য একমাত্র অবলম্বন ছিলো আল্লাহর উপর তাওয়াককুল, এবং আল্লাহই চূড়ান্তভাবে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেছিলেন “ সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করিত” ; “ তাহা হইলে তাহাকে উত্থান দিবস পর্যন্ত থাকিতে হইত উহার উদরে ” (সাফ্ফাত : ১৪৩ ও ১৪৪)। করোনার এই বিপর্যয়ের সময়েও মুমিনদের উচিত নির্ভরতার উপরোল্লিখিত পদ্ধতিসমুহ অবলম্বন করা। যেহেতু একটি অপরটির পরিপূরক সেখানে তিনটি পদ্ধতির অনুসরণ করাই বাস্তব পরিস্থিতি ও সুস্থ বিবেকের দাবি । আলাদা থাকা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, মাস্ক পরিধান করা, পারষ্পরিক নিরাপদ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই যেহেতু এ রোগ থেকে মুক্ত থাকার প্রধানতম উপায়, সেক্ষেত্রে নিজে নিরাপদ থাকা এবং অন্যকে নিরাপদ বা সংক্রমণ মুক্ত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ ও অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করার মত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আল্লাহর উপর নির্ভরতার জাগতিক পদক্ষেপ এবং তারপর সুস্থ ও নিরাপদ থাকার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা রাখা হচ্ছে চূড়ান্ত নির্ভরতা । সুতরাং জাগতিক অবলম্বন গ্রহণ করার সুযোগ থাকা সত্বেও শুধু মাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাথমিক দুই ধাপের নির্ভরতাকে অবহেলা, অস্বীকার কিংবা শীথিলতা প্রদর্শন করা রাসূল (স:) এর দেখানো এবং আল্লাহর শিখানো পদ্ধতির পরিপন্থী । আল্লাহ যখন মানুষ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি ফেরেশতাদেরকে ডেকে তাদের পরামর্শ চাইলেন, (বাক্বারা : ৩০)।
আল্লাহ ইচ্ছা করলে ফেরেশতাদের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকেই মানুষ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন, অধিকন্তু আল্লাহ সেটি না করে প্রাথমিক ধাপের নির্ভরতা হিসেবে ফেরেশতাদের সাথে কাউন্সিলিং করলেন, সুতরাং এটি দ্বারা আল্লাহ তায়ালা নির্ভরতার প্রাথমিক ধাপের উপর গুরুত্ব দিয়ে তারপর চূড়ান্ত নির্ভরতার শিক্ষা দিচ্ছেন । যেকোন যুদ্ধে যাওয়ার আগে রাসূল (স:) আল্লাহর উপর তাওয়াককুলের পাশাপাশি সৈন্যদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য সবধরনের পূর্ব সতর্কতা গ্রহণ করতেন, (আনফাল : ৬০)। শুধু হিজরতই ছিল রাসূল (স:) এর জন্য মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য জাগতিক মাধ্যম, অথচ হিজরতকে নিরাপদ করতে তিনি আরো কয়েক ধাপের প্রয়োজনীয় ধারাবাহিক মাধ্যম অবলম্বন করেন । হযরত আলীকে (রা) নিজের বিছানায় শুইয়ে আসলেন, সফর সঙ্গী হিসেবে আবূ বকর (রা:) সাথে নিলেন, আশ্রয়গ্রহণ করার জন্য গারে সূরকে নির্বাচিত করলেন, খাবার সরবরাহ করার জন্য আসমা বিনতে আবূ বকর (রা:) কে দায়িত্ব দিলেন, রাস্তা প্রদর্শন করার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে উরাইকিত, ছাগলের পদচিণ্হ দিয়ে আসমার (রা:) আসা যাওয়ার পদ চিহ্ন মুছে দেবার জন্য আমের ইবনে ফুহাইরাকে (রা:) নিযুক্ত করেন এবং সর্বোপরী মদীনায় যাওয়ার পরিচিত পথ এড়িয়ে তুলনামূলক কম ঝুঁকিসম্পন্ন কিন্তু বন্ধুর রাস্তা গ্রহণ করলেন । সুতরাং এ সবের মধ্য দিয়ে রাসূল (স:) এর আল্লাহর উপর নির্ভরতা পাশাপাশি জাগতিক সম্ভাব্য উপায় উপকরণকে কর্ম সম্পাদনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার প্রমাণ মিলে । নূহ (আ:) কে আল্লাহ চাইলে সরাসরি কোন অবলম্বন গ্রহণ করা ব্যতিরেকেই জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে নৌকা বানানোর আদেশ দেয়ার মাধ্যমে মূলত জাগতিক অবলম্বন গ্রহণ করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন, (হুদ-৩৭)। ইউছূফ (আ:) যখন জানতে পারলেন যে এক মহা দুর্ভিক্ষ ধেয়ে আসছে মিশরীয়দের উপর, তিনি দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় আল্লাহর উপর নির্ভর করেই ক্ষান্ত হননি বরং পূর্ব সতর্কতা হিসেবে তিনি প্রথম সাত বছর প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাপকহারে খাদ্য-শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে তা পরবর্তী সাত বছরের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় গুদামজাত করে রাখলেন, মানুষদের মিতব্যয়ীতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন যাতে করে দুর্ভিক্ষের সময় পরিমাণ মত খাদ্য-শস্য মজুদ থাকে, (ইউছুফ : ৪৭ ও ৪৮ )। দাউদ (আ:) কে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধে জয়ী হওয়া ও তার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বর্ম তৈরির কাজ শিক্ষা দিয়েছেন, অথচ নবী হিসেবে আল্লাহ চাইলে তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে কোন অবলম্বন ব্যতিরেকেই তাকে বিজয় দান বা ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারতেন, (আম্বিয়া : ৮০)।
মূসা (আ:) এর যখন ফেরাউন ও তার সৈন্যসামন্তদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লোহিত সাগর পাড়ি দেয়া ছাড়া বিকল্প কিছু ছিলনা, আল্লাহ তায়ালা সরাসরি নিজ কুদরতে মূসা (আ:) এর জন্য সাগরের মাঝে রাস্তা তৈরি করে না দিয়ে বরং মূসা (আ:) এর হাতে প্রাথমিক নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে যে লাঠি ছিল তা ব্যবহার করতে বললেন, ( আশ-শূয়ারা : ৬৩) । ক্ষুধা নিবারনের জন্য আল্লাহ মারইয়াম (আ:) কে খেজুর গাছের ডাল নাড়া বা টান দিতে বলেন, যাতে করে গাছ থেকে তাজা খেজুর খেয়ে তিনি তার ক্ষুধা নিবারণ করতে পারেন, (মারইয়াম : ২৫) । আসহাবে কাহাফের যুবকেরা আল্লাহর প্রশংসা করে জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে গেল, যেহেতু আল্লাহর প্রশংসার কারনেই তাদের উপর বিপদ আপতিত হয়েছে, তারা চাইলে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করেই থাকতে পারতো । কিন্তু তা না করে বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর উপর নির্ভরতার পাশাপাশি তারা সাধ্যমত দুটি জাগতিক নির্ভরতার আশ্রয় নিল, এক; নিজেদের রক্ষা করার জন্য গুহায় আশ্রয় নিল, দুই; বিপদ কেটে গেলে খাবার সংকট এড়ানোর জন্য কিছু মুদ্রা সাথে করে নিয়ে গেল, (কাহাফ : ১৩) । ওমর (রা:) ইয়েমেনের একদল মানুষকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কারা ? তারা বললো আমরা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল, জবাবে ওমর (রা:) বললেন বরং তোমরা পরনির্ভরশীল, প্রকৃত নির্ভরশীল সে যে জমিন থেকে তার খাদ্য-শস্য অন্বেষণ করে এবং আল্লাহর উপর নির্ভর করে ।
সুতরাং প্রজ্ঞাবান মানুষেরা নির্ভরতার ক্ষেত্রে শুধু আবেগ দিয়ে নয়, বরং জ্ঞান ও বিবেকের সমন্বয়ে আল্লাহর উপর নির্ভরতার মধ্যপন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে । এটিই মূলত প্রশান্তি, আত্মবিশ্বাস, সম্মান ও শক্তি আনয়ন করে, (তাওবাহ : ৮০) । সর্বোপরী তাওয়াককুলের এ পদ্ধতি চূড়ান্তভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।