করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এখন মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এই ভ্যাকসিন (প্রতিষেধক)। ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাসের একটি ভ্যাকসিন বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) প্রয়োগ করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। মানবদেহে এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সফল হলে আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ ভ্যাকসিনটি বাজারে আসতে পারে বলে আশা করছেন ব্রিটেনের বিজ্ঞানীরা। অক্সফোর্ড বিজ্ঞানীদের তৈরি ভ্যাকসিন নিয়েই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা বেশি বলে গবেষকরা মনে করছেন। কারণ তাদের তৈরি ভ্যাকসিনটি শিশু, ডায়াবেটিস রোগীসহ সব বয়সের মানুষের দেহে কার্যকর হতে পারে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

জার্মানির একদল বিজ্ঞানীও করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেছেন, যেটিকে মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে দেশটির সরকার। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দুটি গবেষক দল করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেছে, যা ইতোমধ্যে মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ শুরু হওয়া নভেল করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ৯০ হাজারের বেশি প্রাণহানি হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ২৭ লাখ মানু। এ ভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন বা ওষুধ এখনও তৈরি করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বে হাহাকার চলছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন) ছাড়া করোনাভাইরাস রোখা অসম্ভব। কারণ প্রতিষেধক, শারীরিক বা রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে হত্যা করা অণুজীব (ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া ও অন্যান্য) থেকে তৈরি করা হয়। প্রয়োগের পরে প্রতিষেধক, আক্রান্তের দেহে অ্যান্টিজেনগুলোকে প্রতিলিপি তৈরি করতে বাধা দেয়। ফলে সংক্রামিত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠে।

মানবদেহে প্রয়োগ অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন

সিএইচএডিওএক্স-১ এনকোভ-১৯ নামের এই ভ্যাকসিন অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় এবং ইমপেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের যৌথ প্রচেষ্টায় মানবদেহে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এই প্রকল্পের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং দ্রুত অগ্রগতি সাধন করেছে বলে গত ২১ এপ্রিল ঘোষণা দেন যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক। তিনি বলেন, ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের একদল বিজ্ঞানীর তৈরি এই ভ্যাকসিন সফল হলে বড় ধরনের এক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে বিশ্ব। বিশ্বে প্রথম এ ধরণের কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো দাবি করে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হ্যানকক বলেন, ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকার বিজ্ঞানীদের অতিরিক্ত ২০ মিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ২০৯ কোটি টাকা) দেবে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের তৈরি এটিই প্রথম ভ্যাকসিন।

এই ভ্যাকসিনটি পরীক্ষার জন্য ৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। বৃহস্পতিবার দুই জনের শরীরের প্রথম প্রয়োগ করা হয় এ ভ্যাকসিন। এখন এ দুজনকে পর্যবেক্ষণে রাখবেন বিজ্ঞানীরা।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের তৈরি ভ্যাকসিন চূড়ান্তভাবে মানবদেহে প্রয়োগের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এজন্য তারা ভ্যাকসিনটির কয়েক লাখ ডোজ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। এক্ষেত্রে ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী যে কোন সুস্থ ব্যক্তি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ, ইউনিভার্সিটি হসপিটাল সাউথাম্পটন এবং ব্রিসটল চিলড্রেনস ভ্যাকসিন সেন্টারে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন। এসব সেন্টারে যেসব স্বেচ্ছাসেবী পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন প্রয়োগে অংশ নেবে তাদের ১৯০ থেকে ৬২৫ পাউন্ড দেয়া হবে।

যুক্তরাজ্য সরকার করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের কাজ এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সিএইচএডিওএক্স-১ এনকোভ-১৯ নামের এই ভ্যাকসিন অক্সফোর্ডের জেনার ইনস্টিটিউটে তৈরি করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানী। এর প্রথম ডোজ গ্রহণের মাধ্যমেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হবে। এর ফলে যারা এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন তাদের শরীরে সংক্রমণের কোন সম্ভাবনা থাকবে না। এমনকি এটি শিশুদের জন্যও নিরাপদ। ডায়াবেটিস বা অন্য কোন রোগে ভুগছেন এমন ব্যক্তি এবং বয়স্কদের জন্যও এটা নিরাপদ।

তিন দফায় এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ৫১০ জনকে প্রথম দফায় এই ভ্যাকসিন দেয়া হবে। যদি প্রথম দফা সফল হয় তবে দ্বিতীয় দফায় ৫৫ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। চূড়ান্তভাবে ৩য় দফায় ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে।

জার্মানির ভ্যাকসিনও মানবদেহে প্রয়োগের অনুমতি

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব (কোভিড-১৯) মোকাবিলায় ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন জার্র্মানির একদল বিজ্ঞানী। ইতোমধ্যে এই ভ্যাকসিন মানব শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে জার্মানির ভ্যাকসিন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। জার্মানির বায়োটেক কোম্পানি ‘বায়োএনটেক’ এ ভ্যাকসিনের গবেষণা চালাচ্ছে। এই ভ্যাকসিন ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ২০০ জন মানুষের ওপর সম্ভাব্য প্রয়োগ করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে গুরুতর করোনা রোগীদের ওপরও এটি প্রয়োগ করা হবে।

বায়োএনটেকের সম্ভাব্য এ ভ্যাকসিনের নাম ‘বিএনটি-১৬২’। ফাইজার নামে আরেকটি ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে যৌথভাবে এ গবেষণা চালাবে প্রতিষ্ঠানটি।

২০ এপ্রিল জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেন্স স্প্যান বলেন, ‘এটি একটি ভালো লক্ষণ যে, জার্মানিতে করোনাভাইরাসের একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা এগিয়ে চলছে। আমরা ভ্যাকসিনটির প্রথম পরীক্ষা চালাতে পারি।’ যদিও জার্মানির ফেডারেল কর্তৃপক্ষ চলতি বছরই জনসাধারণের জন্য টিকা প্রস্তুত হবে বলে মনে করছে না।

জার্মানির ওই কোম্পানির সূত্র অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সি ২০০ সুস্থ স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এই টিকা পরীক্ষা করা হবে। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ফাইজারের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এই টিকা তৈরির চেষ্টা চলছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবীদের শরীরের জন্য আরএনএ বা জিনভিত্তিক সম্ভাব্য এই টিকা কতটা উপযুক্ত ও নিরাপদ, তা পরীক্ষা করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের ওপরও পরীক্ষা চালানো হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্যাথোজেনের জিন সম্পর্কে তথ্যেরভিত্তিতে শরীরে বিশেষ ধরনের প্রোটিন উৎপাদন করা হচ্ছে। এই প্রোটিনের কল্যাণে শরীরে রোগ প্রতিরোধ প্রণালী উপযুক্ত অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে ভাইরাস ওই মানুষকে সহজে কাবু করতে পারবে না।

এদিকে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে কয়েকটি গবেষক দল ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ এরমধ্যে শুরু করেছে। গত মাসে প্রথমবারের মতো মানবদেহে করোনার ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালান যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের বিজ্ঞানীরা। চীনেও একটি ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে।

ভারতের বিজ্ঞানীরাও আশা করছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ তারা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারবেন। দেশটির হায়দরাবাদ বিশ^বিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। এছাড়াও জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরাও করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এর আগে চীন সরকার গত ১৪ এপ্রিল করোনার দুই ধরনের প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য অনুমতি দিয়েছে। দেশটির উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলোজিকাল প্রোডাক্টসের জাতীয় ওষুধ বিশেষজ্ঞ দল ও বেইজিংয়ের সিনোভেক বায়োটেকের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে ভ্যাকসিন (ওষুধ)।

এর আগে সার্স, হেপাটাইটিস-এ ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজে গবেষণা করেছিলেন সিনোভেক বায়োটেকের সিইও ইয়িন ওয়েডং। তিনি বলেন, ‘যদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সফল হওয়া যায়, তাহলে দ্রুত প্রতিষেধক তৈরি করা হবে। বছরে ১০ কোটির বেশি প্রতিষেধক তৈরি করতে সক্ষম তারা।’

চীনা বিজ্ঞানীরা যেসব উপায়ে প্রতিষেধক আবিষ্কারের কথা ভাবছেন, সেগুলো হলো- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সাবইউনিট ভ্যাকসিন, অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন ও নিউক্লিক অ্যাসিড ভ্যাকসিন। চীনের অ্যাকাডেমি অব মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্স আগেই অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন তৈরি করেছে যা এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা গবেষকরা মনে করছেন, সার্স-কভ-২ এর থেকেই কোভিড-১৯ এর সৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ মাস আগেও এই ভাইরাসের জিন কাঠামো সম্পর্কে গবেষকদের কোন ধারণা ছিল না। আজকে সারবিশ্বেই গবেষণার বিষয়বস্তু হলো- ‘কোভিড-১৯’।