নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নের নওপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. শাহ্ আলম গোয়ালের গরু আর পুকুরের মাছ বিক্রির টাকায় করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন মানুষের মাঝে ত্রাণ বিলাচ্ছেন একজন স্কুল শিক্ষক। তাঁর এই কর্মকান্ডকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখলেও হাঁসি ফুটেছে অভাবী মানুষের মুখে। গেল দুই সপ্তাহ ধরে এ ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
চাপিলা ইউনিয়ন জুড়ে অভাবী মানুষ নির্বাচন করে খাদ্য সামগ্রী বিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সহায়তা হিসেবে পরিবার প্রতি ৫কেজি করে চাল এক কেজি আলু আধা কেজি ডাল ও একটি করে সাবান দেওয়া হচ্ছে।
পেশায় শিক্ষক তিনি। সংসারের আয় আর বেতনের টাকায় ভালোই চলে তিন সদস্যের পরিবার। তবে মাস শেষে হাতে সঞ্চয় বলতে থাকেনা কিছ্ ু। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে অভাবী মানুষের দুঃখ কষ্ট বিচলিত করে তাঁর শিক্ষক হৃদয়। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে খেয়ে না খেয়ে থাকা এসব মানুষের জন্য কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু হাতে নগদ টাকা বলতে কিছু ছিলনা তাঁর।পরিস্থিতি বিবেচনায় গোয়ালের দুইটি গরু ও পুকুরের মাছ বিক্রির টাকায় সহযোগীতায় পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জানালেন শিক্ষক শাহ্ আলম।
ওই শিক্ষক জানান, নিজের পরিবার ও সংসারের ক্ষতি করে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটি একাই নিয়েছিলেন তিনি। এনিয়ে ভাবতে হয়েছিল বেশ কয়েক দিন। একদিন দুপুরে খাবার টেবিলে ভয়ে ভয়ে তাঁর ওই সিদ্ধান্তের কথাটি জানিয়েছিলেন স্ত্রী নাজমা বেগম ও কলেজ পড়–য়া মেয়ে উর্মিজাহানকে। তাঁরা ওই সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন জানায়। উপরন্ত বিপদকালে হতদরিদ্র মানুষের জন্য নিজের সামান্য সম্পদের এক্ষতিকে মানবিক সহায়তা হিসেবে দেখছিল স্ত্রী ও সন্তান।
পারিবারিক সিদ্ধান্তের পর গোয়ালের তিনটি গরুর মধ্যে দুই হাটে নিয়ে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। পর দিন পুকুর থেকে মাছ বিক্রি করা হয় আরো এক লাখ টাকার। সাকুল্যে আড়াই লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ত্রাণ হিসেবে কেনা হয় চাল, আলু,ডাল ও সাবান।
এর আগে তাঁর বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন উদ্যোমী ছাত্র ও কিছু অনুগতদের নিয়ে গঠন করা হয় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি। ইউনিয়ন জুড়ে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষুক, ভাসমান পরিবার, বৃদ্ধ ও কর্মহীন ৫০০ মানুষের তালিকা তৈরি করেন ওই স্বেচ্ছাসেবকরা। গত ৪ এপ্রিল থেকে তালিকাভুক্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাদ্য সামগ্রী।
সর্বশেষ সোমবার রাতে ইউনিয়নের কান্দাইল, পমপাথুরিয়া, খামার পাথুরিয়, পাঠানপাড়া, মোকিমপুর, তেলটুপি ও রায়পুর গ্রামে ১০০ পরিবারের মাঝে ওই খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। জানালেন উদ্যোক্তা শিক্ষক শাহ্ আলম। ওই কার্যক্রমের ফাঁকে ফাঁকে জীবানুনাশক ছিটানো সাবান ও মাস্ক বিতরনের কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে বলে জানালেন ওই শিক্ষক।
শিক্ষক শাহ্আলম জানান, ইতিমধ্যে ৫০০ পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন নতুন তালিকা হাতে পাচ্ছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে সাধ্যমত আরো সহযোগীতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন তিনি।
চাপিলা ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবু জাফর মিয়া বলেন, গোয়ালের গরু ও পুকুরের মাছ বিক্রির টাকায় গরিবদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরন কার্যক্রমটিকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছেন। কিন্তু গরিবের পাশে দাঁড়াচ্ছেনা কেউ। কিন্তু একজন স্কুল শিক্ষকের উদারনীতির কারনে অভাবী পরিবারের মানুষের মুখে হাঁসি ফুটিয়েছে।
তিনি আরো জানান,- শাহ্ আলম মাষ্টার একজন উদারপন্থি মানুষ। গরিব পরিবারের মেয়ের বিয়ে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ারেখার খরচসহ নানা রকম সামাজিক কাজের সাথে জড়িত রয়েছেন। একারনে ব্যক্তি উন্নয়ন হয়নি তাঁর। তবে মানবিক উন্নয়ন শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা বাড়িয়েছে তাঁকে।# ১৯.০৪.২০২০
স্বেচ্ছাসেবক ও কলেজ ছাত্র মো. ফরহাদ রেজা কাউছার আহম্মেদ ও সোহরাব হোসেন জানান, – করোনায় কলেজ ছুটি থাকায় শিক্ষক শাহ আলমের ত্রাণ সহযোগীতার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। তাঁদেরমত ২০জন স্বেচ্ছাসেবক যুক্ত রয়েছেন ত্রাণ প্যাকেটজাত ও বিতরণ কাজে। ইউনিয়ন জুড়ে ৭০০ মানুষের তালিকা প্রস্তুত করেন তারাঁ। ইতিমধ্যে ৫০০ পরিবারকে সহযোগীতা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
চাপিল ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন। চুরিমালা ফেরি করে জীবন চলে তাঁর। করোনা পরিস্থিতির কারনে আয়উপার্জন বন্ধ হয়ে পড়ে। স্ত্রী এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে খাবার কষ্টে চলছিল তাঁদের জীবন। সহায়তা পেয়ে খুশি তিনি।
নওপাড়া গ্রামের মহিতুন বেওয়ার (৭০) ভাষ্য ১৫ বছর একমাত্র ছেলে পৃথক খায়। বিধবাভাতার ৩০০ টাকার অনুদান বন্ধ ছয় মাস। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছিল তার। গ্যারামের শাহআল মাষ্টার ডাইকা নিয়া চালের পুটলি (প্যাকেট) ধরাই দিছে।