করোনা ভাইরাসের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবারকে ত্রাণ দিতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রশাসনকে। ত্রাণ বরাদ্দের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি চাহিদা হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ওপর কোনো নিয়ম না মেনে অনেক সচ্ছল ব্যক্তিরাও ত্রাণের আবেদন করে উপজেলা প্রশাসনকে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলছেন। এ অবস্থায় এসএমএস (শর্ট মেসেজ সার্ভিস) এর ভিত্তিতে জরুরী ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। তবে ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বাকি বিল্লাহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সচল রাখার আশ্বাস দিয়েছেন। এক্ষেত্রে করোনার দুর্যোগে আক্রান্ত পরিবারকে ত্রাণ পেতে তার সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
জানা যায়, এ উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ছয়টি ইউনিয়নের ১১৩ টি গ্রামে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বসবাস। পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। এর মধ্যে ২৫ হাজার পরিবারের খাবারের জোগার হয় প্রতিদিনের কর্ম ও আয়ের উপর নির্ভর করে। এই ২৫ হাজার পরিবারের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার পরিবার একেবারেই হতদরিদ্র ও দুস্থ। এই ১০ হাজার পরিবারের মধ্যে ৭ হাজার ৬০০টি পরিবার ভিজিএফ কার্ডের এবং ২ হাজার ৯৬টি পরিবার ভিজিডি কার্ডের সুবিধা পাচ্ছেন। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ডধারী এই পরিবারগুলো কিছুটা স্বস্তিতে আছেন। তবে কর্মহীন হয়ে পড়া আরো প্রায় ১৫ হাজার পরিবার সরকারের সহায়তায় দিকে চেয়ে আছেন।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত মাসের ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ সরকারি ছুটি ঘোষণা এবং যানবাহন ও সাধারণ মানুষ চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপ করায় উপজেলার হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে অনেক পরিবারের সদস্যদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে থাকে। পরে তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে সহায়তা পেতে ধরনা ধরেন। এ অবস্থায় উপজেলা প্রশাসন ওইসব কর্মহীন পরিবারকে সহায়তা দিতে সরকারের কাছ থেকে দুই ধাপে ৫১.৪ মেট্রিক টন চাল ও আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ পান। এই বরাদ্দ দিয়ে গত দেড় সপ্তাহে উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ৪ হাজার ২০০ পরিবারকে ১০ কেজি চাল, হাফ কেজি ডাল, ১ লিটার তেল ,হাফ কেজি লবণ ও একটি সাবান দেয়। তবে সেখানেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ দিতে স্বজনপ্রীতি করেন বলে বলে অভিযোগ ওঠে। সেসময় জরুরী ভিত্তিতে সেবা দিতে মোবাইলে এসএমএস (শর্ট মেসেজ সার্ভিস) এর মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দেয়ারও উদ্যোগ নেয় উপজেলা প্রশাসন। ৫০০ টি পরিবার এই সেবা পান। তবে গত দশ দিনে উপজেলা প্রশাসনের হট লাইন নাম্বারে বরাদ্দের চেয়ে অধিক এসএমএস এসেছে। এরমধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৫০০ পরিবারকে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অভিযোগ ওঠে, এই সেবায় অনেক সচ্ছল পরিবারও ত্রাণের জন্য আবেদন করে। এতে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কর্মকর্তাদের। এ অবস্থায় বরাদ্দের চেয়ে বেশি এসএমএস আসার প্রেক্ষিতে গত শুক্রবার থেকে ত্রাণ বিতরণের এই জরুরী সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
এদিকে এই সেবা কার্যক্রম বন্ধের পরেও ভুক্তভোগী জনসাধারণ এখনো উপজেলা প্রশাসনের মোবাইলে এসএমএস করছেন। কিন্তু তারা কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষগুলো আরো হতাশায় পড়েছেন। তবে হতাশ হয়ে পড়া এই কর্মহীন মানুষদেরকে আশার আলো দেখাচ্ছে ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বাকি বিল্লাহ। তিনি করোনায় ভুক্তভোগী ত্রাণ না পাওয়া পরিবারকে তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তাহলে তিনি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঐসব পরিবারকে ত্রাণের যোগান দিবেন বলে জানান।
উপজেলার পাথরকাটা গ্রামের বাসিন্দা চাঁদ আলী বলেন, ‘আমি ভ্যান গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাই। আজ ১৫ দিন হলো ভ্যান গাড়ি নিয়ে বের হলেও কোনো যাত্রী পাইনা। আগে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে আয় করতাম। এখন সারা দিনে ১০০ টাকাও ভাড়া পাইনা। চার দিন আগে সরকারি ত্রাণ পাওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনের নাম্বারে এসএমএস করেছিলাম। কোনো সাড়া পাইনি। এতে শনিবার উপজেলা পরিষদে গিয়ে ত্রাণ চাই। কিন্তু কর্মকর্তারা আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন। পরে উপজেলা চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে ত্রাণ পাই।’
উপজেলার অষ্টমণিষা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ আয়নুল হক বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ৪ হাজার পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে আড়াই হাজার পরিবার করোনা ভাইরাসের কারণে দুর্ভোগের শিকার। কিন্তু সরকারি ত্রাণ পেয়েছে মাত্র ৪০০ টি পরিবার। এ পরিবারগুলোকে গত এক সপ্তাহ আগে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ স্বল্প পরিমাণে সহযোগিতা করেছে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে। এরই মধ্যে সব পরিবারেই ত্রাণের চাল শেষ হয়ে গেছে। এতে দুর্যোগের শিকার প্রত্যেক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ পরিস্থিতে দ্রুত ত্রাণের পরিমাণ বাড়ানো দরকার।’
মুন্ডুতোষ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ বলেন, তার ইউনিয়নে ২ হাজার ৫০০ পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে ২ হাজার পরিবারই হতদরিদ্র। কিন্তু সরকারি ত্রাণ পেয়েছে মাত্র ৩৮০ টি পরিবার। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে ত্রাণের পরিমাণ বাড়ানো একান্ত দরকার বলে তিনি জানান।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একদিকে বরাদ্দের চেয়ে ত্রাণের চাহিদা অনেক বেশি। অন্যদিকে অনেক সচ্ছল ব্যক্তি এবং একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ত্রাণ চেয়ে প্রশাসনকে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। এতে স্বল্প জনবল নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি সেবা প্রদানের জন্য এসএমএস পদ্ধতি আপাতত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, যেহেতু পর্যায়ক্রমে ত্রাণ আসছে। তাই ত্রাণের অপ্রতুলতা আছে বলে আমি মনে করিনা। একের পর এক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ত্রাণ পেয়ে যাবে। যেহেতু এই পরিস্থিতিতে একসাথে দূর্ভোগে পড়া সব পরিবারকে ত্রাণ দেয়া যাচ্ছে না। সেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বেশি অসহায় ও দুস্থ পরিবারকে আগে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে এসএমএসের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বাকি বিল্লাহ বলেন, আমার উপজেলায় কোনো অভাবগ্রস্ত লোক না খেয়ে থাকবে এটা মেনে নিতে পারবোনা। তাই আমি বিশেষ ব্যবস্থায় করোনার দুর্যোগে আক্রান্ত পরিবারকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সহায়তা দিয়ে যাব। এসময় তিনি ভুক্তভোগী ত্রাণ না পাওয়া পরিবারকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান।