সেই আহ্বান যেন হারিয়ে যাচ্ছে’

পৃথিবীজুড়ে চলমান করোনা ভাইরাস আক্রমন বাংলাদেশেও এসে পড়েছে। এটা এক অন্য
ধরনের যুদ্ধ। এখানে শত্রুকে দেখা যায়না। কিন্তু শত্রু আমাকে ঠিকই টার্গেট করছে। কি
এক ভয়াবহ পরিস্থিতি-! ভাবা যায়না আমরা কত কঠিন অবস্থা মোকাবেলা করছি। গত
ডিসেম্বরের শেষে চীনের উহান প্রদেশ থেকে এই যুদ্ধ শুরু হয়ে এখন ছড়িয়ে গেছে
বিশ্বের ১শ’ ৮৭ টি দেশে। ইউরোপের ধনাঢ্য দেশগুলোও পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে
পারছেনা। মানুষ মারা যাচ্ছে। এর অন্যতম কারন রোগটি নতুন, এর নেই কোন প্রতিষেধক।
মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় এই ভাইরাস। মানুষ আর মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছেনা।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই চিরায়ত আহ্বান যেন এখন অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে।
একাত্তর সালে আমরা সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ করলেও মরণঘাতি করোনা ভাইরাস মোকাবেলা
যুদ্ধের আমাদের কোন অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু আজকের এই আধুনিক ও প্রযুক্তিতে
উচ্চমাত্রার এই সময়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করা খুব একটা কঠিন কাজও নয়। যখন চীনের
উহানে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি গ্রহন করার
সুযোগ ছিল, আমরা সময়ও পেয়েছি অনেক। যেমন চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপদ পোষাক ও
সরঞ্জাম তৈরি ও প্রস্তুত রাখা। সারাদেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাকর্মীদের করোনা
সম্পর্কে ধারনা ও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে মনবল মজবুত রাখা, কোয়ারেন্টাইন এর জন্য
ব্যবস্থা রাখা; সর্বোপরি করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ‘কীট’ আমদানি
করে রাখা এই কাজগুলো সরকারি উদ্যোগে করে রাখা খুব একটা কঠিন ছিলনা।
আমরা যদি চীনের পাশের দেশ তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকাই
তাহলে দেখা যাবে, উহানে করোনা আক্রমনের পরপরই এসব দেশে সড়ক, শপিং মল, স্টেশন,
পর্যটন এলাকা সর্বত্র এন্টি-ভাইরাস মেডিসিন স্প্রে শুরু করে। একই সাথে তারা
চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপদ পোষাক-পিপিই (পারসোনাল প্রটেক্টেড ইক্যুইপমেন্ট)
তৈরি, পর্যাপ্ত পরিমান মাস্ক, হ্যান্ডগ্লোবস তৈরি এবং ব্যাপক জনসচেতনতামূলক
প্রচারণা চালায়। তারা জনসমাগম নিয়ন্ত্রন করে। এভাবে তারা সফল হয়েছে। এইসব দেশে
ক্ষতির পরিমান কম। এখানেই আমাদের দু:খ, আমরা আড়াই মাস সময় পেয়েও কোন কাজে
লাগাতে পারি নাই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কয়েকজন ব্যক্তির কথাবার্তা শুরু থেকেই
ছিল অসহনীয় মাত্রার। তাদের কথার ভাবটাই ছিল অন্যরকম, যেন এই সমস্যাটি তারা ফুঁ
দিয়েই মোকাবেলা করবে–!
আরেকটি মারাত্মক গাফিলতি আমাদের দেশে হয়েছে সেটি হচ্ছে, চলমান এই
সংকটজনক সময়ের মধ্যে অবাধে প্রবাসীদের দেশে ঢুকতে দেয়া। অথচ এই সময়ে অনেক
দেশই বিদেশী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, এয়ারলাইন্স বন্ধ ইত্যাদি পদক্ষেপ নেয়। চীনের পর করোনার
মারাত্মক আক্রমনের শিকার ইতালি হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী
আমাদের দেশে এসেছেন। ইতালিসহ অন্যান্য দেশ মিলিয়ে প্রায় ৬লাখ প্রবাসী গত দুই
মাসে আমাদের দেশে এসেছেন। সর্বশেষ ১লাখ ৪০ হাজার এসেছেন যাদেরকে এখন হন্যে
হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রশাসন। এসব ভুলগুলো এখন চরম সংকটের জন্ম দিয়েছে এবং
জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে।

উল্লেখিত ভুল অথবা গাফিলতির জন্য আমরা শুধু সরকারকে দায়ী করে বসে থাকলে হবেনা।
এই সংকটটি স্বল্প সময়ে চীন মোকাবেলা করতে পেরেছে সেই দেশে সাধারন মানুষ
সহযোগিতা করেছিল বলেই। সরকারের সকল নির্দেশনা মানুষ মেনে নিয়ে বাড়িতেই
অবস্থান করেছে। জাপানসহ অনেক দেশেই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে সরকারি-
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জরুরি কাজগুলো হচ্ছে। অর্থাৎ অফিসে যেতে হবেনা, বাড়িতে
বসে ল্যাপটপে প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো (২৩ শে মার্চ)
পর্যন্ত এটা করা হয়নি।
দু:খজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান, গ্রুপের মালিক
আছেন। বহু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে যেগুলোতে কি সম্ভব ছিলনা প্রয়োজনীয়
পরিমান মাস্ক ও চিকিৎসাকর্মীদের পোষাক তৈরি করে সরবরাহ করতে-? তাদের সংগঠন
বিজিএমই অনেক শক্তিশালী। তাদের তো উচিত ফ্যাক্টরিগুলো এক মাসের জন্য বন্ধ করে
কর্মচারীদের বেতন দিয়ে দেয়া। এসব কোনটিই তারা না করে শুধু সুযোগ খোঁজেন
কিভাবে ব্যাংক লোনের কিস্তি বা সুদ মওকুফ করানো যায় তা নিয়ে। এই হচ্ছে আমাদের
দেশপ্রেমিক শিল্পপতিদের মানসিকতা-!
অথচ সামর্থ না থাকলেও আমরা দেখছি ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা
স্যানিটাইজার তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলি করছে। বিদ্যানন্দ নামে একটি
সংগঠন সড়কে রিক্সাচালকদের মাস্ক দিচ্ছে, হাতে স্যানিটাইজার লাগিয়ে দিচ্ছে।
যারা বিদেশ থেকে এসেছেন তাদের আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব রয়েছে। শুধু নিজে বাঁচার
ব্যাপার নয়, সকলকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা না করলে বিপদ বাড়বে। বিদেশ ফেরতদের নিজেরা
সচেতনভাবে কোয়ারেন্টাইনে না থাকলে বিপুল সংখ্যক এই মানুষদের সনাক্ত করা স্বল্প
সময়ে কঠিন। আসুন আমরা সবাই মিলে ‘করোনা যুদ্ধ’কে মোকাবেলা করি। বাঙালি
সাহসি জাতি, আমরা একাত্তরে হায়েনাদের পরাস্থ করেছি, বন্যা-মহামারির মত কত
কিছুই তো মোকাবেলা করে চলতে হয় আমাদের; সেইভাবে চলমান এই করোনা যুদ্ধেও
আমাদের জিততে হবে। ( লেখক: ঈশ্বরদীর সিনিয়র সাংবাদিক, কলাম লেখক। সাবেক
সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব)। ২৩.৩.২০২০