৪৭ বছর আগে ১৯৭৩ সালের পহেলা জানুয়ারি মধ্যরাতে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটিতে প্রবেশ করেছিল। তখন প্রথম ইউরোপিয়ান কমিশনার এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের জামাতা ক্রিস্টোফার সোয়ামস বলেছিলেন, ব্রিটেন একটি দুঃসাহসিক কাজ শুরু করল। ৪৭ বছর ২৯ দিন ২২ ঘণ্টার মাথায় সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, বর্তমানের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ব্রিটেনের জন্য উপযুক্ত নয়। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের সম্পর্কে যে কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা ব্রেক্সিট থেকেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানো এবং অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবি মেটানোটা ‘স্বাধীন’ ব্রিটেনকে কতদূর নিয়ে যাবে বা শেষ পর্যন্ত এই জট আদৌ কাটবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে বিশেষজ্ঞদের। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের বৈবাহিক জীবনটা কখনোই সুখের ছিল না। তবে ইইউ যে ভাঙবে না তাও বলা দুষ্কর।
ব্রিটেন এখন স্বাধীন : ব্রিটেন একটি শাসক রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত। বিশ্বের অনেকগুলো দেশেই ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়েছে। ভারতবর্ষেও ২০০ বছরের বেশি শাসন করেছে। কিন্তু সেই ব্রিটেন নাকি স্বাধীন হলো গত শুক্রবার রাত ১১টায়। দেশটি নাকি সার্বভৌমত্বও ফিরিয়ে পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরিসের কথায়ও এর আভাস পাওয়া গেছে। তিনি ব্রিটেনে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। ব্রেক্সিটপন্থিরা বলছেন, যুক্তরাজ্য স্বাধীন দেশ, ইইউর অংশ নয়, ইউরোপের মূল ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণহীন অভিবাসন হবে না, ইইউর তহবিলে যুক্তরাজ্যকে শত শত কোটি পাউন্ড চাঁদা দিতে হবে না, যুক্তরাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্রাসেলসের খবরদারি থাকবে না, ব্রিটিশ আইনের ওপর থাকবে না ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিসের কর্তৃত্ব, ব্রিটিশ জেলেরা সমুদ্রসীমায় ইচ্ছেমতো মাছ ধরতে পারবে ইত্যাদি।
সত্যিই স্বাধীন! : ব্রেক্সিটপন্থিরা যে কারণে স্বাধীন বলছেন, আপাতত সেটি কিন্তু হচ্ছে না। সবকিছু আগের মতোই থাকবে, অন্তত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওপরের নীতিগুলো কার্যকর হবে ২০২১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে। তবে এর আগে ব্রিটেন ও ইইউর মধ্যে ভবিষ্যত্ সম্পর্ক নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। ব্রেক্সিটপন্থিদের কাছে শুক্রবার ছিল উল্লাসের, আর বিরোধীদের কাছে শোকের দিন। ব্রিটেনে এমন অনেক দম্পতি আছে যাদের একজন ব্রিটিশ ও আরেক জন ইউরোপের কোনো দেশের। এতদিন তারা যেন একই দেশের নাগরিক ছিলেন যখন খুশি আসা-যাওয়া ও চাকরি-বাকরি করতে পারতেন। ব্রেক্সিট তাদের সেই সম্পর্কে বজ্রাঘাত করে ভিন্ন দেশের বাসিন্দা বানিয়ে দিয়েছে। আবার জার্মানিতে ব্রিটেন একজন মেয়রও হারিয়েছে। জার্মানির ১৭০ জন বাসিন্দার ছোট্ট শহর ব্র্যান্সমার্কের মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন স্কটিশ আয়ান ম্যাকানাব। তৃতীয়বারে তার মেয়াদ ২০২৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু শুক্রবার তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কারণ ব্রিটেন ইইউ ছাড়ায় তিনি ভোটাধিকার হারিয়েছেন। বরিস নিজেও স্বীকার করেছেন, ব্রেক্সিটপন্থি ও বিরোধীদের বাইরে দেশে তৃতীয় পক্ষের নাগরিক বেশি যারা মনে করেন, এই রাজনৈতিক গোলযোগ কখনোই শেষ হবে না।
স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ভঙ্গ হবে! : ২০১৬ সালের ২৩ জুন গণভোটের পরের দিন হ্যারিপটার খ্যাত লেখিকা জে কে রাউলিং বলেছিলেন, ‘বিদায় ব্রিটেন। স্কটল্যান্ড এখন স্বাধীনতা খুঁজবে। ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে ভাগ করবে। অথচ দুটোর কোনোটারই দরকার ছিল না’। তার সেই বার্তাই কিন্তু এখন সত্যি হতে চলেছে ! নর্দান আয়ারল্যান্ডে আরমাঘ নামে সীমান্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ হয় শুক্রবার। ঠিক ১১টায় স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজন ইইউর পতাকার ছবি টুইট করে বলেন: স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউরোপের কেন্দ্রে ফিরবে স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডের জন্য একটি বাতি জ্বালিয়ে রাখুন বা লিভ এ লাইট অন ফর স্কটল্যান্ড উল্লেখ করে একটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়। কার্ডিফে ওয়েলসের ফার্স্ট মিনিস্টার মার্ক ড্রেকফোর্ড বলেন, ওয়েলস ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দিলেও এটি ইউরোপীয় জাতি হয়েই থাকবে।
বাণিজ্যেও চাপে থাকবে ব্রিটেন : ওয়াশিংটনে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কিম ডারোক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ব্রেক্সিট উত্তর বাণিজ্য চুক্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্রিটেনের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করবেন। বিশেষ করে মার্কিন ওষুধের বেশি মূল্য তিনি দাবি করবেন। তিনি বড়ো মার্কিন কোম্পানি ও কৃষকদের লন্ডনের মার্কেটে অবাধে প্রবেশাধিকার দাবি করতে পারেন। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেন স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে ইইউ-ব্রিটেন ভবিষ্যত্ বাণিজ্যের আলোচনায় ব্রাসেলস তার স্বার্থ রক্ষায় লড়াই করবে।