হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন নারী অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। বিদেশ গমন, ভ্রমণ, সম্পদের হস্তান্তর ও দানপত্র তৈরী, আদালতের প্রামাণিক, বৈধপন্থায় তালাক প্রদানে নারীকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। রোধ হচ্ছে বাল্য বিবাহ।
বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। সারাদেশের প্রায় সকল উপজেলায় একজন করে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক নিয়োগ দেয় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
আইনে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বাধ্যবাধকতার শিথিলতা, প্রচারণার অভাবের কারনে সব বিয়ে নিবন্ধন হচ্ছে না। বর্তমানে গড়ে প্রতিবছর চার হাজার বিয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর মাধ্যমে সরকার বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার রাজস্ব পাচ্ছে। পাশাপাশি সকল উপজেলায় একজন করে নিবন্ধকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
নিবন্ধকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিবাহ নিবন্ধনে সরকার নির্ধারিত ফি এক হাজার টাকা। এর ষাট ভাগ সরকার রাজস্ব হিসেবে এবং অবশিষ্ট চল্লিশ ভাগ পান নিবন্ধক। বিয়ে বাড়ীতে নিবন্ধকের যাতায়াতের খরচ সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বহন করতে হয়। সাধারণত বাঁশি বিয়ের দিনে নিবন্ধন কাজ সমাধা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে পরেও নিবন্ধন সম্পাদন করা হয়।
ধর্মীয় রীতিতে প্রচলিত বিয়েতে কোন কাবিননামা থাকে না। বিবাহিত জীবনের বাঁকে বাঁকে নারী হয়ে ওঠে অসহায়। অথচ একটা মাত্র আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে অর্জিত বিবাহ নিবন্ধন কাগজটিই জীবনকে করে তুলতে পারে সহজ-সুন্দর।
বিয়ে নিবন্ধন না থাকার দূর্দশা সম্পর্কে ভুক্তভোগী বিপ্লব কুমার সরকার (ছদ্রনাম) বলেন, প্রবাস জীবনের পরবর্তী সময়ে স্ত্রীকে দেশ থেকে নিয়ে যেতে ভোগান্তীর শেষ ছিল না। পুরোহিতের কাছ থেকে সনদ সংগ্রহ করে নোটারী পাবলিকের দপ্তরে সাক্ষী উপস্থাপন করে নোটারী পাবলিকের সনদ সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে উপস্থাপনের পরে মিলেছে স্ত্রীর সেই কাংখিত ভিসা। ছুটিতে দেশে বেড়াতে বের হই। তবে বিবাহ নিবন্ধন না থাকায় তা প্রদর্শনে ব্যর্থতার কারনে সব সময় সব হোটেলে থাকা যায় না বলে জানালেন দেশে ভ্রমন পিপাসু জয়ন্ত মানী (ছদ্রনাম)। স্বামী তাঁর স্ত্রী সঞ্চিতা দেবকে (ছদ্রনাম) ব্যাংকে ‘ডিপিএস’ হিসাবের নমিনী করেছিলেন। স্বামীর অনাকাংখিত মৃত্যুর পরে সঞ্চিতা দেব তাঁর বিয়ের প্রমাণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে প্রদানে ব্যর্থ হন। শুরু হয় ভোগান্তির দিনরাত্রি।
উল্লেখিত সকলক্ষেত্রে একটিমাত্র কাগজ অর্থাৎ বিয়ের নিবন্ধন সকল ভোগান্তির নিরসনে যথেষ্ট। নাটোর ও নলডাঙ্গা উপজেলার দায়িত্বে নিয়োজিত হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক এবং বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় হিন্দু ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার কল্যাণ সমিতির সহ সভাপতি সুবীর বর্ধন মুন জানান, বিবাহ নিবন্ধন নারীকে সুরক্ষা দিয়েছে ব্যাপকভাবে। অসংখ্য সুবিধা থাকার কারণে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরুর পর ২০১৫ সালে মাত্র চারটি বিয়ে নিবন্ধন হয়েছিল। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৬টি। প্রশাসনিক তৎপরতা এবং জনপ্রতিনিধিদের উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমে বিয়ে নিবন্ধন হার বাড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস।
দেশে প্রচলিত ১৮৭৬ সালের তালাক/ ডিভোর্স রেজিষ্ট্রেশন আইন এবং ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনে মুসলিমদের বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত না থাকায় অবৈধভাবে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বা আইনজীবী সহকারীর মাধ্যমে হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। আইনের সংশোধন করে বিবাহ বিচ্ছেদে হিন্দুদের অন্তর্ভূক্ত করার দাবী জানিয়ে এই নিবন্ধক বলেন, মুসলিম নিকাহ রেজিষ্ট্রারের মত আমাদের কার্যক্রমে বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা হলে তা হিন্দু নারীদের সুরক্ষা দেবে। পাশাপাশি সরকার পাবে রাজস্ব। একই মত ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় হিন্দু ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার ধর। তিনি আরো বলেন, শতভাগ বিয়ে নিবন্ধন নিশ্চিত করা গেলে বাল্য বিবাহও রোধ করা সম্ভব হবে।
নাটোর জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সুশান্ত ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদসহ হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী অন্যান্য সংগঠনের দীর্ঘ দিনের দাবীর প্রেক্ষিতে সরকার হিন্দু বিবাহ আইন করেছে। এই আইন বিয়েতে উভয় পক্ষকে সুরক্ষা দিলেও নারীর সুরক্ষা অনেক বেশী। আমরা চাই আইনের সংশোধন করে সকল বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হোক।-বাসস