ইয়ানূর রহমান : ঘরের বিছানাটা ঠিক সেই ভাবেই সাজানো। ঘুম থেকে ওঠার পর যেভাবে সাজিয়ে রাখতেন তনিমা ইয়াসমিন পিয়াসা। পড়ার টেবিলটা এলোমেলো। শূন্য চেয়ারে বসার কেউ নেই। গায়ে হলুদের ফুল ডালি যত্ন করে রাখা। প্রতিদিন বাড়িতে ভিড় করছেন হবু ডাক্তার পিয়াসার বান্ধবীরা। তাদের সবার মাঝে পিয়াসাকে খুঁজছেন মা রেহেনা আক্তার হীরা ও বাবা ইয়াসিন আলী। আর তানজিলা ইয়াসমিন ইয়াসার স্বামী সুমনকে তাদের পাশে পাশে রাখছেন। মনে হচ্ছে সুমনের মাঝে লুকিয়ে আছে ইয়াসার স্মৃতি। মাঝে মাঝে তাদের দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসছে। সব আছে আগের মতো নেই শুধু তাদের নাড়ি ছেঁড়া ধন পিয়াসা ও ইয়াসা। এই দুই মেয়েই ছিলো ইয়াছিন আলী ও রেহেনা আক্তার হীরার অবলম্বন।
মঙ্গলবার দুপুরে নিহত দুই বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চোখের কোনে পানি নিয়ে মুখ ভার করে বসে আছেন বাবা ইয়াছিন আলী ও মা রেহেনা আক্তার হীরা। তাদের পাশেই রয়েছে বড় জামাই সুমন (ইয়াসার স্বামী)। বাড়িতে আসা লোকজনের দিকে তাকিয়ে আছেন দুই সন্তান হারানো দম্পতি। সবার কথা শুনছেন আর নিরবে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। কোন ভাবেই সান্ত্বনা মিলছে না। সন্তান হারানোর কষ্টে তারা কাতর। দুই মেয়ের স্মৃতিকে ঘিরেই সময় কাটছে তাদের।
মা রেহেনা আক্তার হীরা জানান, আমাদের কোন ছেলে সন্তান নেই। পিয়াসা ও ইয়াসা বড় আদরের ছিলো। ছোট বেলা থেকেই দুই মেয়ের কোন দাবি অপূর্ণ রাখিনি। আমাদের ফাঁকি দিয়ে দুই মেয়ে এক সাথে চলে যাবে কখনো ভাবিনি। এই বুঝি মনে হলো মেডিকেল কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেই পিয়াসা বলছে “আম্মু খুব ক্ষুধা লেগেছে। তাড়াতাড়ি খেতে দাও”। ওর বিছানার দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কবে ঘুমাবে ওই বিছানায়। পিয়াসার ব্যবহৃত কসমেটিকগুলো সাজিয়ে রেখেছি। স্মৃতি হিসেবে তুলে রেখেছি গায়ে হলুদের ফুল ডালি। প্রতিদিন অনেকে বাড়িতে আসছেন। সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ আর আম্মু বলে ডাকছে না বলে কাঁদতে থাকেন মা হীরা।
বাবা ইয়াসিন আলী জানান, আমার সোনাপাখি পিয়াসা ও ইয়াসা আর কোন দিন ফিরে আসবে না। কিন্তু তাদের চেহারা চলাফেরা চোখের সামনে ভাসছে। বাড়ির চারিপাশে দুই মেয়ের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। বড় একা করে চলে গেলো। বড় সখ ছিলো মেয়েকে ধুমধুমের সাথে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো। অনেক আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করেছিলাম। কিন্তু সখ পূরণ হলো না। স্বামীর সংসারে যাওয়ার আগেই পিয়াসা না ফেরার দেশে চলে গেলো। এছাড়া আমার পিয়াসার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হয়ে মানবসেবা করা। সেই স্বপ্ন সড়কে শেষ হয়ে গেলো। আমাদেরও এখন আর কোন স্বপ্ন নেই। আমার ঘরের আলো চিরতরে নিভে গেলো। দোয়া করি “আল্লাহ তুমি আমার দুই মেয়েকে শান্তিতে রেখো”। এদিকে স্বজনরা জানিয়েছেন, আগামী শুক্রবার আসর বাদ আর এন রোডের মদিনা স্টোর, শনিবার একই সময়ে লোন অফিস পাড়ায় শফিকুল ইসলাম জ্যোতির বাড়িতে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার রাত পৌনে ১ টার দিকে যশোর শহরের পুরাতন কসবা নিরিবিলি পাড়ায় আকিজ গলির মুখে প্রাইভেটকার দুর্ঘটনায় নিহত হন দুই বোন পিয়াসা, ইয়াসা ও তাদের ভাবি আফরোজা তাবাসসুম তিথী। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন, নিহত তিথীর মেয়ে মানিজুরা (৩), লোন অফিসপাড়া আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম জ্যোতি, তার বন্ধু মৃত আবুল কাশেমের ছেলে হৃদয় (২৮) ও শেখহাটির শাহিন হোসেন (২৩)। স্বজনরা ভাষ্যমতে, বর্তমানে হৃদয় ও মানিজুরার অবস্থা গুরুতর। তারা ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হৃদয়ের মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে আরেক হাড়ের উপর চলে গেছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর অথবা থাইলান্ডে নেয়া হবে ৷