সুন্দর চিন্তা-চেতনা ও সৎ কর্মের প্রবাহ জগত সংসারকে মধুময় করে। সাধারণ মানুষ সৎ, নিষ্ঠাসম্পন্ন, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি, মহাপুরুষ অথবা মহামানবের জীবনাচরণ এবং জীবনাদর্শকে অনুসরণ করে সুখী হয়। ধন-সম্পদ, টাকা-কড়ির প্রাচুর্য মানুষের ভোগ বিলাসকে চরিতার্থ করায়। এরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সম্পদের অতি বিশালতা, অতি প্রয়োজন হতাশাও আনে জীবনে। যতটুকু প্রয়োজন এর অতিরিক্ত কুক্ষিগত করা অপরাধের সামিল। মানুষকে সুখী করতে এবং জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিরুপনে পরম পুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কিছু দৃষ্টান্তমূলক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আজকের আলোচ্য বিষয় এটিই। তিনি ছিলেন ধর্মীয় মহাপুরুষ। কিন্তু একটি ধর্মীয় ভাবাদর্শের উপর তিনি নির্ভরশীল ছিলেন না। জগতে দেখা যায় তিনি ব্যতীত সকল মহাপুরুষ একটি মাত্র ধর্ম মতের প্রচার, প্রসার বা সংস্থাপনের কার্য করে গেছেন। আর এতে কোটি কোটি মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। পরমহংসদেব তিনি হিন্দু, খ্রিস্টান, ইসলাম, বৈষ্ণব, শাক্ত, তন্ত্র, বেদান্ত সকল পথে সাধনা করে দেখালেন তিনি অনন্ত ভাবময়।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস নূতন কোন ধর্ম সংস্থাপন করেননি। তিনি লক্ষ্য করলেন বিভিন্ন ধর্মীয় মতাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্বেষ ভাবের বহিপ্রকাশ। একে অন্যের মত পথের আদর্শকে ঘৃণার চোখে দেখছে। এতে হানাহানি, মারামারি বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। এ অবস্থা দূরীকরণে তিনি অহিংস, ত্যাগ ও প্রেমের পথ দেখানোর জন্য সকল ধর্ম মতে সাধনা করে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “সকল ধর্মীয় মত পথ সত্য। আন্তরিক হলে সকল পথে পরম স্রষ্টাকে লাভ করা সম্ভব।” পৃথিবীতে অনেক ধর্ম আছে। ধর্মগুলোকে ঈশ্বর বা স্রষ্টাকে লাভের একেকটি পথ বা উপায় বলেছেন তিনি। তাঁর শ্রেষ্ঠ একটি বাণী, “যত মত তত পথ।” এ তথ্যটুকু জানলে আমাদের ধর্মীয় বিদ্বেষ আর থাকে কোথায়? হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আমরাতো সকলে এক পরিবার হয়ে যাই। অথচ আমরা এক পরিবারে কত হানাহানি করছি। যা বিশ্ববাসীর জন্য লজ্জাকর। পৃথিবীতে ধর্মীয় বিদ্বেষ নিয়ে যত রক্তপাত হয়েছে, অন্যথায় এতো হয়নি। এ অবস্থার অবসানের জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন। তিনি ধর্মগুলোর মধ্যে সেতু রচনা করলেন। যাতে একে অন্যের ধর্মীয় আদর্শগুলো গ্রহণ করে পুষ্ট হতে পারে। দেহের জন্য যেমন সুষম খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সকল ধর্মের আদর্শ প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর দৈহিক বা মানসিক পুষ্টির পরিপূরক।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্যতম শিষ্য। রামকৃষ্ণ পরমহংসের গন্ডিহীন ধর্মভাব সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রম। যে প্রতিষ্ঠানে থাকবে না জাতিভেদের প্রশ্ন। থাকবে শুধু ভালোবাসা। প্রেম ও সেবা কার্য। সেবাই পরম ধর্ম। মূলত প্রত্যেক ধর্মের ধর্মীয় আচার এবং পদ্ধতিগুলো শুধু ভিন্ন। কিন্তু সকল ধর্মাবলম্বী উপাসনালয়ে গিয়ে এক অসীম সত্তাকেই চিন্তা করে। ধর্ম মূলত আন্তলালন, চর্চা এবং ব্যবহারিক জীবনে নিষ্ঠা প্রয়োগের জিনিস। বাহ্য অনুষ্ঠানগুলো সহায়ক মাত্র। এ জগতের স্রষ্টা এক। সকলকে সহমর্মিতার সঙ্গে বাস উপযোগী করে জগত সৃষ্টি করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসহিষ্ণু কর্মকান্ড দেখা যায়। এর কারণ হলো অজ্ঞানতা। আকাশে কালো মেঘ জমলে এর কিয়দংশ অন্ধকার হয়ে যায়। বাকী অংশ আলোকিত থাকে। তেমনি কিছু মানুষের অজ্ঞানন্ধ আচরণে জগতে অশান্তির সৃষ্টি হয়।
এ অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে জীবকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতেই রামকষ্ণ পরমহংসদেবের আগমন। যত অন্ধকার সব মনের মধ্যে। তিনি একটি সুন্দর উপমা দিয়েছেন, “মনটি দুধের মত, সেই মনকে যদি সংসার জলে রাখ, তাহলে দুধে জলে মিশে যাবে। তাই দুধকে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তি রূপ মাখন তোলা হল, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার জলের সঙ্গে মিশে যাবে না। সংসার জলের উপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে।” আমরা সংসারজীবি। কিছুটা বিচার করে চলতে হয়। কোনটি নিত্য অর্থাৎ স্থায়ী, কোনটি অনিত্য অর্থাৎ অস্থায়ী সে বিচার। আজকের সুউচ্চ অট্টালিকা একদিন ধসে পড়বে, এতো রস-রঙের জীবন যেকোন সময় মৃত্যুর করাল গ্রাসে নিপতিত হবে। কি আশায় এবং কিসের নেশায় আমাদের অমূল্য মানব জীবনকে হেলার চোখে দেখছি। এ জিনিসটিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরম হংসদেব। আর্তপীড়িত, বুভুক্ষা, অজ্ঞ, অশিক্ষিত, অধম, পতিত, এদের উদ্ধারের জন্যই তাঁর ধরায় অবতীর্ণতা। একদিন পূণ্যভূমি গমনের পথে বুভুক্ষু, হাড্ডিসারদের পথিমধ্যে খাবারের ব্যবস্থা করে, পরে তীর্থে যান। এ হলো শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি প্রাণে প্রাণে চৈতন্যের উপস্থিতি টের পেতেন। কচি তৃণের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে তিনি হৃদয়ে কাঁটা বিধার আঘাত পেতেন। এটি তাঁর নিজ মুখের কথা। মূলত বিশ্বপ্রাণের সহিত তিনি ছিলেন অভিন্নাত্মা। মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে যা হয়। মাঝ নদীতে দুজন মাঝি ঝগড়া করে একজনের পিঠে অন্য জন আঘাত করায় শ্রীরামকৃষ্ণের পিঠে অঙ্গুলির ছাপ পড়ে এবং তিনি কাতরে ওঠেন।
এ মহাপুরুষকে নিয়ে লিখার উদ্দেশ্য পাঠককূলের সার্বিক কল্যাণের জন্য। মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে মহাপুরুষ, মহামানবগণের নিকট হতে। তাঁদের জীবনাদর্শ, তাঁদের অমৃতকথা, হিতোপদেশে সাধারণ মানুষের জীবনের মোড় ঘুরে। অমানুষ থেকে মানুষে, মানুষ থেকে দেবত্বে উন্নীত হয়। মানব সমাজের সর্ব কল্যাণময় প্রভু শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর নিকট পতিত থেকে মহামান্যজন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমবাবু, মাইকেল, কেশবসেন প্রমুখ অমৃত কথা শ্রবনে বিমুগ্ধ হয়েছেন এবং জীবনের দিশা পেয়েছেন অনেকেই।
পরমহংস জীবনের ব্যতিক্রমী ঘটনা, যা জগতে বিরল, আর তাহলো তিনি দাম্পত্য জীবন গ্রহণ করেছেন, কিন্তু সাধারণের মতো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক করেননি। পাঁচ বছর বয়সী সহধর্মীনি শ্রীমা সারদা দেবীকে অধ্যাত্ম সাধনায় শিষ্যা করেছেন। যার ফলে তিনি গৃহে থেকে আজন্ম সন্ন্যাসী। তাঁকে পীর, দরবেশ, আউলিয়া উপাধিতে ভূষিত করা যায়। এমন চরম ত্যাগ জগতে আর কটি? এমন জাগতিক মোহহীন জীবন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এজন্যই জগতের সকল ধর্মীয় পুরুষগণকে ভাবতে বা চিন্তা করতে হয়। তাহলে তাঁদের ভাব আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। আমরাও আলোকিত হই। প্রভু যীশু, প্রিয় নবীজী, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র, চৈতনদেব, বুদ্ধদেব তাঁদের জ্যোতির পরশেই আমরা আজ মানুষ। নতুবা আমাদের জীবন অরণ্যচারীদের মতো হতো। এতো সুন্দর সুশৃঙ্খল হতো না। পৃথিবীর সেরা জীবের উপাধি মানব ললাটে অঙ্কিত হতো না। পৃথিবী নামক এ গ্রহটিতে আগত অনাগত সকল মহাপুরুষ, মহামানব, পীর, দরবেশ, আউলিয়া, সাধু-সন্ন্যাসীগণের চরণে ভক্তি নিবেদন করে এ লিখার সমাপ্তি করব।
রুচি বৈচিত্র্যে ঈশ্বর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা ধর্ম করেছেন। এগুলো অবলম্বন করে একই পরম বস্তুকে লাভ করে মানুষ। কাজেই কোন ধর্মাবলম্বী, অন্য কোন ধর্ম বা ধর্মপীরকে ঘৃণার চোখে দেখলে; প্রকারান্তরে স্রষ্টাকে অসম্মান করা হয়। কারণ সব তাঁরই সৃষ্টি। সৃষ্টিকে ভালোবাসলে স্রষ্টা পুলকিত হন। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মমত এক বাক্যে স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির কথা অবলীলায় স্বীকার করে। সেহেতু মানব কল্যাণে ধর্মীয় মত, ধর্মীয় মহাপুরুষগণের উপদেশ বিভিন্ন লিখনীর মাধ্যমে প্রচার করা একান্ত কর্তব্য বলেই বোধ হয়। কোন নাম-যশ, খ্যাতি লাভের আশায় নয়। কর্তব্য বোধেই এ লিখা। একটি বিশেষ বিষয় বর্তমানে দেখা যায় সেটা হলো খাদ্যাখাদ্য বিচার। খাদ্যের সঙ্গে ধর্মের তেমন কোন সম্বন্ধ আছে বলে জানা নেই। যা দেহের জন্য উপযোগী তা মাছ থেকে মাংস হোক বা সবজি। শুধু সবজি জাতীয় খাবার খেলে যদি মেধা, মনন, কায়িক সবলতা না আসে তবে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। মাছ, মাংস, ডিম খেলে মেধা, মনন, কায়িক শক্তি বৃদ্ধি পায়। এগুলোর বিরুদ্ধে কিছু মানুষ উদ্ভট তথ্য দিয়ে সমাজকে নির্জীব করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরকে। মেধা, মনন, কায়িক সবলতা না থাকলে কোন ধর্মই পালন হবে না। দুর্বল মস্তিষ্ক ভালো জিনিস ধারণ করতে পারে না। আর ভালো ও উৎকৃষ্ট হলো সততা, নিষ্ঠা, পবিত্র চিন্তা, অপরের কল্যাণ সাধন করা। নয়-ছয় করে উপার্জন না করা। এগুলোই ধর্ম-কর্ম। এগুলো যে কোন সময়ে, যে কোন স্থানে পালন করা সম্ভব। শুধু আন্তরিক হলেই হলো।