আশুতোষ সাহা
প্রতি বছর বঙ্গদেশে বা সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত স্থানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ পূজায় আনন্দের জোয়ার বসে সমস্ত দেশে। শত শত বছর পূর্ব হতে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিশাল মাহাত্ম্য সম্বলিত এ পূজা সমাজের সকল স্তরের মানুষকে আনন্দ ধারায় আপ্লুত করে। শুনা যায় রাজা কংস নারায়ণ বঙ্গ সমাজে প্রথম এ দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। পরে তা সর্বত্র অনুষ্ঠিত হতে থাকে। কোন অসাধ্য কাজ সাধন করতে হলে, মেধা মনন বা শক্তির প্রয়োজন। আর এ শক্তি নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে সঞ্চিত। আমরা বাহ্য দৃষ্টিতে দেখি কায়িকভাবে পুরুষ শক্তিশালী। কিন্তু বিস্তরভাবে নারী শক্তির বর্ণনা বিধৃত করা একান্ত প্রয়োজন। তাই ছোট একটি উদাহরণে বি¯তৃত ব্যাখ্যা করা হলো এ নারী শক্তির।
সমাজের ছোট থেকে বড় প্রত্যেকটি পরিবারের দিকে তাকালে দেখা যায়, পিতার চেয়ে মায়ের শক্তি ও মেধা প্রয়োগে প্রতিটি পরিবার কি অদ্ভুত রূপে পরিচালিত হয়! সংসারে স্বামী, পুত্র-কন্যা, শ্বশুর-শ্বাশুরী, ভাসুর-নন্দাই, চাকর-বাকর, বাড়ির পশু-পাখিসহ সকল কিছুর পরিপালক যেন সংসারের এ মা। কিভাবে, কোন্ বলে বা শক্তিতে এতো কিছুর ম্যানেজমেন্ট সম্পন্ন করেন, ভাবলে হতভম্ব হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এ জন্যই সনাতন ধর্মে মাতৃশক্তি এবং এর প্রকাশকে একটি শিল্পকর্ম বা সৃজনশীল কাঠামোর মধ্যে প্রদর্শন করা হয় দুর্গা পূজায়। তত্ত্বমতেও আমরা জানি ভগবান শ্রীরামচন্দ্র দাম্ভিক নিধনে মাতৃশক্তির সহায়তা নিয়েছিলেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ মাতৃশক্তির আরাধনা করেছেন নিরন্তর। রামকৃষ্ণ সংঘ গঠনে সারদা দেবীর মেধা ও মনন এবং কায়িক শ্রমের ব্যাপকতা দেখলে মাথা ঘুরে যায়।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সকল ধর্মে স্বীকৃত। তিনি নিরাকার। প্রয়োজন বোধে জীবের কল্যাণার্থে সাকার রূপে আবির্ভুত হন। এ তত্ত্বটি সনাতন ধর্মের আবি®কৃত। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর শক্তিরূপে নারী বা পুরুষের মধ্যে বিরাজিত। আর সবার মধ্যেই শক্তি নিহিত। নারী বা পুরুষ প্রত্যেকেই কোন না কোন প্রকারে সে শক্তিকে ব্যবহার করে সাংসারিক উন্নতি সাধন করছে। এ দুয়ের মধ্যে হেয় বা প্রেয় বলতে কিছু নেই। সম্পূর্ণরূপে সমান। আমাদের অজ্ঞতার কারণে নারীকে বা নারী শক্তিকে হেয় চক্ষে দেখি। আমরা দেখতে পাই কোন পরিবারে নারী শক্তি রুষ্ট হলে, সে পরিবারটির আর অস্তিত্ব থাকে না। পৃথিবীতে যে সব দেশ নারীকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছে, সে সব দেশ খুব উন্নতি সাধন করেছে।
যাহোক বসন্তকালে এ পূজা বাসন্তী পূজা নামে অভিহিত হয়। আর শরৎকালে যে পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তা শারদীয় পূজা বলে কথিত। শরৎকাল দেবতাগণের সায়ংকাল। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রাবণ নিধনে অসময়ে মা দুর্গাকে তুষ্টার্থে পূজা করেছিলেন। অকাল বোধনে মাকে খুশি করে শত্র“ নিধন করেছিলেন তিনি। শত্র“ দুভাবে মানুষকে আঘাত করে; একটি হলো বাহ্য ভাবে, অন্যটি অভ্যন্তর ভাবে। যে সব ভাব মানুষকে কুপথে বা বিপথে নেয়; সে ভাবটি অভ্যন্তর ভাবের শত্র“। আর বাহ্য ভাবেরটি হলো স্বার্থ ব্যাঘাতের বিষয়। শেষেরটির কারণে জগতে বিশাল অশান্তি সৃষ্টি হয়। এ অশান্তিকে শুভ শক্তি সহায়ে শান্ত অবস্থায় আনতে হয়। দুর্গাপূজায় সারা দেশে একটি আনন্দের বাতাবরণও তৈরী হয়। জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ ধারা প্রবাহিত হয়। বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু সমাজে একটা পারিবারিক বন্ধনের বিচ্ছিন্নতা, দূরীভূত হয়ে এক ঐকতানের সৃষ্টি হয়।
দুর্গাপূজা মূলত শক্তি পূজা। শক্তির গুরুত্ব আমরা সবাই বুঝি। সৃষ্টির সকল কিছুর মূলে হলো শক্তি। বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তাশক্তি, মানসিকশক্তি ইত্যাদি। শক্তি বিহনে এগুলো মূল্যহীন। তাই শক্তিকে প্রসন্নার্থে এ পূজা। পূজা বলতে পরমেশ্বর-স্বরূপ তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অবনত হওয়া বুঝায়। যার শক্তি, সে আর তার শক্তি অভেদ। তাই শক্তিও পূজ্য। যেমন, অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তি।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ পূজার মাহাত্ম্য অশেষ। এ পূজা উপলক্ষ্যে কত মানুষ যে বিভিন্ন উপায়ে উপকৃত হয়, তার শেষ নেই। ঢাকাী, মালী, তাঁতী, পসারী, ময়রা, কামার-কুমোর, মৃৎ শিল্পী এরা বিশাল ভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করে।
বারো মাসে ফলদানকারী কলা গাছকে নব সাজে বধুরূপে সজ্জিত করে মায়ের সঙ্গী করা হয়। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের উপাদান নব পত্রিকা এ পূজার উপকরণ। মায়ের সন্তান হিসেবে পতিতা থেকে রাজপাটের কেহই মায়ের আশির্বাদ বঞ্চিত হয়নি। শরৎকাল নীলিমার শোভায় অপরূপা। এ সময়েই মা দুর্গা কৈলাশ হতে মর্তে শুভাগমন করেন, মনুষ্য কুলকে পরম পরশে পুলকিত করতে। জগতে হীন বলের স্থান নেই। শুদ্ধ চিন্তাসহ অসুর রূপী রিপুকে দমন করার যে একটি পরিকাঠামো, এ প্রতীকে ফুটে ওঠে, তা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্প, সংস্কৃতি, বিদ্যা, ধনৈশ্বর্য, ক্ষাত্রশক্তির প্রণোদনা, সংসার জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পরিস্ফুট হয় দুর্গা প্রতিমার সৃজনশীল কাঠামোতে।
সৃষ্টি এবং শিল্প কর্মের মধ্যেই ফুটে ওঠে ঈশ্বরের অব্যক্ত ভাবের আসল রূপটি। তাই বিশ্বব্যাপি শিল্প কর্মের এতো কদর। আর শিল্পীরাও মনের মাধুরী মিশিয়ে অপরূপ শোভা দানে পরিপ্লুত করে দুর্গাপূজার কাঠামোটিকে। এ থেকে অনেক শিক্ষা লাভে ধন্য হয় ভক্তকুল। তাই একটি দুর্বার আকর্ষণ থাকে কবে আবার ফিরে আসবে এ পূজা।
এ জগতে সকল ধর্মাবলম্বী শক্তিকে মানে। তাই বিশেষ শক্তির আধার বিভিন্ন মহাপুরুষ, মহামানবকে মানুষ এতো পূজ্য এবং তুল্য করে তাদের গুণগান করে নিজে পবিত্র হয় ও তাদের আদর্শ গ্রহণ করে। এ পূজায় মূলত অন্তরের শক্তি বিকশিত হয়। আন্তঃশক্তি বিকশিত করার নামই ধর্ম। অন্তঃকরণ ছোট বা সীমিত যার, তার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। মুনি, ঋষিগণ যুগ যুগ ধরে সাধনা করেছেন নিজ অন্তর বিকশিত করার জন্যই। আর দেখাও যায় দুর্গাপূজায় যে আনন্দ ধারা প্রবাহিত হয়, তাতে সকলের মনের কালিমা, কলুষ অনেকাংশেই দূরীভুত হয়।
অত্যাচারী শম্ভু, নিশম্ভু, মহিষাসুর ও রম্ভাসুর মাতৃশক্তির কাছেই নিরস্ত্র হয়ে বধ্য হয়। দুর্গম অতিক্রান্তকারী মা দেবী দুর্গাই এদের নিধনের কারণ হয়েছিলেন। কাজেই জগত কল্যাণে মাতৃশক্তির মহিমা অসীম। এ মহিমাকে প্রকাশ এবং সমুজ্জ্বল করাই দুর্গাপূজার তাৎপর্য। শরতের ধূ-ধূ বালু চড়ে সাদা কাশ ফুলের রৌদ্রজ্জ্বল সমীরন দোলায় মায়ের মর্তে শুভাগমন। তাই চারদিক থাকে তখন আনন্দ হিল্লোলে মায়ের আগমনী প্রতীক্ষায় ভক্তকুলের মনও থাকে উচাটনে। কখন মা আসবেন। শুধু এ আলোচনা। এ সংসার খুবই দুরধিগম্য অতীব দুর্গম। ভব সাগরও বলা হয়। এ সাগর অতিক্রম করতে হয় মনুষ্য কুলকে। আর এতে কত যে নাকানি-চুবোনি খেতে হয়, এর ইয়ত্তা নেই। তাই দুর্গা মায়ের কৃপা প্রার্থনা করলে, এ ভব পারাবার সহজ হয়। কথিত আছে দুর্গম নামক এক অসুর দেবতা কুলকে অত্যাচার করতো। দেবগণ অতীষ্ট হয়ে মহামায়া দুর্গার শরণাপণ্য হলে, মা সে অসুরকে নিধন করে শান্তি স্থাপন করেছিলেন। তাই সর্বদা মাতৃ জাতিকে আদৃত করা উচিত। নারী জাতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মহা অপরাধ। আমরা পুরুষ জাতি যেন এ ভাগীদার না হই।
দুর্গা মায়ের মহিমা সম্বলিত শাস্ত্রের বহুল প্রচলিত মন্ত্রটি সবিশেষ উল্লেখ্য ও প্রণিধানযোগ্য ঃ যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা, নমস্তসৈ, নমস্তসৈ, নমস্তসৈ নমো নমঃ। অর্থাৎ, মাতৃ শক্তিরূপে সকল জীবের মধ্যে তিনি বিরাজিতা। তাই জীব স্বরূপ শিব। জীবের আবরণ এবং আচরণটি শুধু তার অতীত কর্মফলের ফল স্বরূপ। জন্ম-জন্মান্তরের আবরণ সরে গেলে স্বরূপ প্রাপ্তি এবং নিস্তার।
আমাদের অজ্ঞানতার কারণে ঈশ্বরের নিকট আমরা ক্ষুদ্র জিনিস চেয়ে বসি। মা দুর্গার নিকট ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এ চারটি জিনিস চাওয়া হয়, যার যার চাহিদা অনুযায়ী। জ্ঞানীগণ মায়ের নিকট মোক্ষ লাভের প্রার্থনা করেন। যা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রার্থনা। আমরা যেন জ্ঞানী মহাজনদের পন্থা অবলম্বন করি। মরিচিকাচ্ছন্ন বস্তু যেন মায়ের নিকট না চাই। সকল ধর্মই বলে সবকিছু ঈশ্বর থেকে জাত হয়েছে। একজন মা থেকে যেমন অনেক সন্তানের জন্ম হয়; তেমনি ঈশ্বর থেকেও সব জাত হয়েছে। তাই ঈশ্বর মাতৃবৎও। চতুর সাধকগণ সহজে ঈশ্বর লাভ করতে-ঈশ্বরকে মাতৃভাবে সাধনা করে কৃত কৃতার্থ হয়। ঈশ্বর আরাধনায় মাতৃভাব খুব শুদ্ধভাব। সেখানে কোন নিুগামী চিন্তা অনুপ্রবেশের সুযোগ পায় না। তাই সকল দেব-দেবীতে মাতৃভাব আরোপ পূর্বক আমরা যেন তাঁকে মনন করি। এতে আমাদের সকলের প্রভুত উন্নতি সাধিত হবে।
মানুষ সুন্দরের পূজারী। তাই এমন একটি ধর্মীয় শিল্প কর্মের মধ্যে সত্য সুন্দর ঈশ্বরকে ভাবতে বা চিন্তা করতে আনন্দ পাওয়া যায়। পরমা প্রকৃতির øিগ্ধ পরিবেশে, মা দুর্গা প্রতিবছর ভক্তকুলকে কৃপা প্রদর্শন করতে, বছরের এমন সময়ে বিশেষ রূপে আবির্ভূতা হন। এ জগতটা একটা মস্ত পরিবার। মানুষ, জীব-জন্তু, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারা আরো কত কি মিলে। দেবী দুর্গাও একটি সমন্বিত পরিকাঠামোয় মর্তে শুভাগমন করেন। সকল কিছু সুষ্ঠু, সুন্দর, সুচারুরূপে চালিত হোক এটি সকলের চাওয়া। দুর্গতি নাশিনী মা দুর্গা প্রকারান্তরে এ কাজটিই করেন জীব কুলকে সুখী-সুন্দর রাখতে। আমরা যেন শুদ্ধ চিন্তা চর্চার মাধ্যমে মায়ের কাছে প্রার্থনা করি, মা আমাদের মানুষ কর। মনের পশুত্ব আমাদেরকে অনেকাংশে অধোগামী করে রেখেছে। তোমার কৃপায় মনের এ পশুত্ব নাশ হোক। প্রত্যেকের মন যেন হয় দীপ্তিময়। মনের ধ্যান অধ্যাত্ম জীবনের দ্বার স্বরুপ। মা দুর্গাকে ধ্যানে, মননে আমাদের মনের মধ্যে যেন স্থাপন করি, তাহলে মায়ের কৃপা অনবরত আমাদের মধ্যে বর্ষিত হবে এবং মানব জনম সার্থক হবে।