রাশেদ রাজন:
চাকরি প্রত্যাশীর স্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের অডিও ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে প্রো-ভিসি চৌধুরী মো. জাকারিয়ার নিজের অবস্থান তুলে ধরতে সাংবাদ সম্মেলনর আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) বিকেলে ৪টায় শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনে এর আয়োজন করা হয়।
এসময় প্রো-ভিসি তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, কথিত নিয়োগ বাণিজ্যে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানিকর কোনো ঘটনা আমার দ্বারা সংগঠিত হয়নি। বরং আমি নিয়োগ বাণিজ্য উদঘাটন ও প্রতিরোধে সদা সচেষ্ট থেকেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি পবিত্র স্থানে নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন ও সত্য প্রকাশের জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
একইসাথে নিয়োগ কেলেঙ্কারিকে ”লোকমুখে প্রচলিত” দাবি করে তিনি বলেন, ”সামগ্রিক নিয়োগ বাণিজ্যসহ আইন বিভাগের নিয়োগ নিয়েও আর্থিক লেনদেনের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।”
ফাঁস হওয়া অডিও’র বিষয়ে অধ্যাপক জাকারিয়া বলেন, গণমাধ্যমে আমার ফোনালাপ বিষয়ে যেসব সংবাদ প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে; তা একটি স্বার্থান্বেষী মহল আংশিকভাবে, খ-িতভাবে, অসৎ উদ্দেশ্যে প্রকাশ করেছে।’
তবে ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডটির কথোপকথন তুলে ধরা হলো-
অধ্যাপক জাকারিয়া: হ্যাঁ, সাদিয়া। আমি প্রফেসর জাকারিয়া (চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া), প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।
সাদিয়া: আসসালামু আলাইকুম স্যার।
অধ্যাপক জাকারিয়া: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আচ্ছা মা, একটা কথা বলতো, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা, তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি।
সাদিয়া: স্যার, সত্যি কথা বলতে…
চৌধুরী জাকারিয়া: না না, সত্যি কথাই তো বলবা। উপরে আল্লাহ তায়ালা, নিচে আমি।
সাদিয়া: অবশ্যই, অবশ্যই। স্যার, আপনি যেহেতু তার অবস্থা জানেন, আরেকটা বিষয় এখানে স্যার, সেটা হচ্ছে, আপনি হুদার… মানে, এমনিতে সে কতটা স্ট্রিক্ট…, আপনি বোধহয় এটাও জানেন স্যার, একটু রাগচটা ছেলে।
চৌধুরী জাকারিয়া: আচ্ছা রাখো রাখো, এখান থেকে কথা বলা যাবে না। এর পর ফোন কেটে যায়.”
রেকর্ডটির ”তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি।” এই অংশে প্রো-ভিসি আর্থিক লেনদেনে সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি অসম্পূর্ণ ও এডিট করা দাবি করে নিজের সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে যান।
সংবাদ সম্মেলনে জাকারিয়া বলেন, ‘আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের বোর্ড ছিলো গত বছর ১৩ নভেম্বর। এর ৯ দিন আগে ৪ নভেম্বর আইন বিভাগের নিয়োগ সংক্রান্ত একটি দুনীতির নথি আমার নজরে আসে। যা ইসলামী ব্যাংকে ২ লাখ টাকার একটি লেনদেনের রিসিপ্ট। সেই বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখতে পাই, ওই লেনদেনটি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শাখা থেকে রাজশাহীর আলুপট্টি শাখায় জমা হয়েছে। আমি আলোচিত নিয়োগ প্রার্থী নুরুল হুদাকে ছোটবেলা থেকেই স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে সাহায্য-সহযোগিতা করে এসেছি। এ কারণে আমার সন্দেহ হয় যে, হুদার আর্থিক সামর্থ্য নেই। কিন্তু কোথা হতে সে এ টাকা লেনদেন করেছে। তিনি স্বাবলীল ভঙ্গিতে নিজের নাম ও পরিচয় দিয়ে হুদার স্ত্রীর নিকট হতে ২ লাখ টাকার উৎস জানার চেষ্টা করেন। তারা আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি স্বীকার করেছিলো। কিন্তু কাকে দিয়েছিলো ওই সময় পরিপূর্ণ তথ্য দেয়নি।’
প্রো-ভিসি আরও বলেন, ‘তার জামাতার নিয়োগের জন্য হুদার চাকরি হয়নি; তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ”আইন বিভাগের নিয়োগ বোর্ড ছিল ১৩ নভেম্বর, সিন্ডিকেট হয়েছে ১৭ নভেম্বর, যোগদান হয়েছে ১৮ নভেম্বর ২০১৮। কিন্তু আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে ২৪ এপ্রিল ২০১৯।’
৪ নবেম্বর দুর্নীতির বিষয়টি তার নজরে এলেও উপ-উপাচার্য হিসেবে তখনি কেন ব্যবস্থা নেননি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ম্যাজিস্ট্রেট এর পেশা থেকে ছাত্রদের পাঠদান ও গবেষণার জন্য শিক্ষকতায় এসেছি। তাই এ বিষয়ের তদন্ত করিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তদন্ত না হয়ে কোন দাবি উঠলে তা ঠিক না। এর পূর্ণ বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে যে তথ্য পত্রিকায় এসেছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।’
সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া। তবে কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেন, ‘লিখিতভাবে প্রশ্ন করা হলেও সে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যান তিনি।’
এসময় নিয়োগের অর্থ লেনদেনের বিষয়ে কথোপকথন দাবি করে আইন বিভাগের সভাপতি আব্দুল হান্নান ও নুরুল হুদার মধ্যকার একটি অডিও ক্লিপ ও ‘ডিসেন্ট টেডার্স’ নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এর বিস্তারিত লেনদেনের তথ্য সাংবাদিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এবিষয়ে সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের অনুরোধ করেন প্রো-ভিসি।
এদিকে উপ-উপাচার্যে দাবির বিষয়ে আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান জানান, ‘ওই এ্যাকাউন্টটি একটি যুক্ত ও ব্যবসায়িক একাউন্ট। আইনজীবী শফিকুল ইসলামের সাথে আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিসেন্ট ট্রেডার্স পরিচালনা করেন তিনি। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ধার হিসেবে একটি একাউন্ট থেকে ডিসেন্টের এ্যাকাউন্টে টাকা আসে। কার্যক্রম হালনাগাদের কাজ চলছে জানিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ্যাকাউন্টটি বন্ধ রেখেছিলো। পরে তা চালু করে দেয়া হয়েছে।’
তার দাবি, ”উপ-উপাচার্য ব্যাংক এ্যাকাউন্টের যে কাগজ দেখিয়েছেন তা অসম্পূর্ণ, ছবিতে ব্যাংক কতৃপক্ষের সীল-স্বাক্ষর থাকার কথা, তা কিন্তু নেই। সেটা দেখে মনে হয়, ছবিটা পেস্ট করা। এছাড়াও সে কাগজটি শুধু এ্যাকাউন্টধারীই পেতে পারেন। উপ-উপাচার্য কীভাবে এই কাগজ পেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ফোনালাপের বিষয়ে অধ্যাপক হান্নান বলেন, ‘যে কল রেকর্ড উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটা ধার করা টাকা ফেরত সংক্রান্ত। ওই নিয়োগের এক সপ্তাহ আগেই সেটা হয়েছিল তবে নিয়োগের কোন বিষয় নিয়ে হুদার সাথে আমার কথা হয়নি। ৪ নভেম্বর ২০১৮ আমার একাউন্টে টাকা আসে এবং ১১ নভেম্বর ফেরত হিসেবে চেক জমা দেই এবং ১৩ তারিখে তা ক্লিয়ার হয়ে গেছে।