টেন্ডার-সম্রাট শামীমের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণকারী সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে কমপক্ষে ১২ কর্মকর্তা গা ঢাকা দিয়েছেন। টেন্ডারবাজি করে অগাথ বিত্তের মালিক হওয়া যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের কাছ থেকে এইসব কমকর্তা বিভিন্ন সময় কমিশন ও উৎকোচ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে শামীমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এতে গণপূর্তসহ বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এসব কর্মকর্তা নিজেদের নাম ফাঁস হওয়ার আতঙ্কে ভুগছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন ও র্যাবসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে তারা আড়ালে চলে গেছেন। পরিবারের সদস্য ছাড়া কেউ জানেন না তারা কোথায় আছেন। এমন কি নিজেদের দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত ফোনটিও বন্ধ রেখেছেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ বছরে যু্বলীগ নেতা শামীম ১৭ হাজার কোটি টাকার টেন্ডার ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন। টেন্ডার বাণিজ্যে তিনি প্রতিটি কাজ বাগিয়ে দিয়ে ২ থেকে ৫ শতাংশ কমিশন নিতেন। এই কমিশনের একটি অংশ চলে যেত তাকে টেন্ডার পেতে সহায়তা করা সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। অর্ধশতাধিক কর্মকতা শামীমের কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নিলেও উৎকোচ গ্রহণের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন কর্মকর্তা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের ৪ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ৪০ দিনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার তিনটি কাজ থেকে জি কে শামীম কমিশন পান ২৭ কোটি টাকা। এছাড়া প্রতি বছর তার টেন্ডারবাজির ভাগ-বাটোয়ারা ছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এখান থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা তিনি কমিশন হিসেবে পেতেন। তবে পুরো টাকা অবশ্য শামীম একাই লোপাট করতেন । কমিশনের টাকা থেকে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী, দলীয় নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংগঠনের ভাগ নিতেন। তবে কমিশনের একটা বড় অংশ উৎকোচ বাবদ চলে যেত তাকে টেন্ডার পেতে সহায়তাকারী সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জি কে শামীমের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও টিপু সুলতান এবং ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই। পাশাপাশি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আক্তারুজ্জামান উৎকোচের বিনিময়ে জিকে শামীমের সব কাজে বৈধতা দিনে। কিন্তু শামীম গ্রেপ্তারের পর থেকে এ চার কর্মকর্তার কাউ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
গণপূর্তের সাবেক দুই প্রকৌশলী সর্ম্পকে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, প্রধান প্রকৌশলী পদে রফিকুল ইসলাম থাকার সময় তার প্রধান সহযোগি ছিলেন, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই। তাদের সিন্ডিকেটে ছিলেন বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী। রফিকুল ইসলাম সরাসরি ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন আদায় করতেন। গুরুত্বপূর্ণ জোনের দায়িত্ব পালনকারি সব নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকেও প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতে হতো রফিককে। ঠিকাদারি কাজ দিতে তিনি আগে থেকেই তিন থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন। এর বাইরে অন্য প্রকৌশলীরা যে কমিশন পেতেন, তাদের কমিশনেও ভাগ বসাতেন রফিকুল ইসলাম। নিজে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব ছাড়ার আগে একদিনে সবচেয়ে বেশি বদলির রেকর্ড করে গেছেন তিনি।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, নিজের অবৈধ অর্থ দিয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ টি বিভিন্ন আয়তনের প্লট কিনেছেন রফিকুল ইসলাম। ৩০০ ফুট রাস্তার উপর প্লট থাকলে দাম দর না করেই কিনে ফেলতেন তিনি। রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, তার দুই স্ত্রী। তাই স্ত্রী ও সন্তানদের নামেই বেশি প্লট কিনেছেন তিনি। মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যরা প্লট কেনার জন্য রাজউকে হাজিরা দিতে আসতেন।
এদিকে আরেক সাবেক প্রধান প্রকৌশলী টিপু সুলতান গণপূর্ত অধিদপ্তরে আসার আগে ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)- এর প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে। ওইখান থেকেই শামীমের সঙ্গে তার সখ্য। পরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে আসার পর টিপু সুলতানের সঙ্গে জিকে শামীমের ঘণিষ্ঠতা আরও বেড়ে যায়। শামীম যে গণপূর্তে প্রধান প্রকৌশলীর কাছের লোক এটা হয়ে ওঠে ওপেন সিক্রেট।
গুলশানের নিকেতনে নিজ কার্যাল জিকে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই রফিকুল ইসলাম ও টিপু সুলতান গা ঢাকা দিয়েছেন। ফোন বন্ধ রয়েছে তাদের। গণপূর্ত অধিদপ্তরের বর্তমান অন্য প্রকৌশলীরা ভয়ে আছেন। অনেকে ফোন বন্ধ করে রেখেছেন, অনেকে অপরিচিত নম্বরের ফোন ধরছেন না। এমনকি গণপূর্ত অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটটিও তারা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর পেয়ে যেন ফোন দিতে না পারেন এজন্য এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই এবং দুই দফা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এসএএম ফজলুল কবির ঠিকাদার শামীমের অন্যতম সুবিধাভোগী ছিলেন। এদের মধ্যে ফজলুল কবির এখনও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে কাজ করছেন।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, জিকে শামীম গ্রেফতারের পর ফজলুল কবির রোববার অফিসে কিছু সময়ের জন্য এসেই হাওয়া হয়ে যান। গতকালও অফিস করেননি এ কর্মকর্তা। নিজের ফোনটি তিনি বন্ধ রেখেছেন।
গৃহায়ন কর্মকর্তাদের ধারণা, এসএএম ফজলুল কবিরের দুই দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পেছনে জিকে শামীমের হাত রয়েছে। কারণ এ নিয়োগ পেতে যত ধরনের অর্থায়ন সবই তিনি করেছেন। বিনিময়ে জিকে শামীমের সঙ্গে মিলেমিশে ট্টপিক্যাল হোমসকে কম দামে জমি দেয়াসহ সব কিছুর প্রক্রিয়া করেন ফজলুল কবির। ফজলুল কবিরের জড়িত থাকার বিষয়টি জানতে চাইলে তাকে বার বার ফোন করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
জি কে শামীমের কাছ থেকে সুবিধাভোগী এসব শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বর্তমানে গণপূর্ত ও গৃহায়ণে কর্মরত আর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তারাও গত দুই দিন অফিস করেননি। ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, পরিস্থিতি ঠান্ডা হলেই তারা অফিস করবেন। বর্তমানে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।