হিজরতের মাধ্যমেই ইসলামের প্রকাশ ঘটে পুরোপুরিভাবে এবং হিজরতেই ইসলামের জন্য মুসলমানদের সবচেয়ে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেত-খামার সব ছেড়ে শুধু নিজেদের জীবন নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। এ জন্য হিজরতের বছরকেই বর্ষ গণনার জন্য বেছে নেয়া হয়।
হযরত উমর রাযি. যখন হিজরি সনের গণনা শুরু করেন তখন রাসূলের হিজরত থেকে ১৭ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। রাসূলের হিজরতের বছরকে প্রথম হিজরি ধরে ১৭ হিজরিতে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শক্রমে হযরত উমর রাযি. মুসলমানদের হিজরি সনের সূচনা করেন।
হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে। হিজরি সন গণনা করা হয় চাঁদের হিসাবে। ইসলামের প্রায় সব বিধিবিধানের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে। তাই চাঁদের হিসাব রাখা ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ প্রত্যেক এলাকার কিছু মুসলমান যদি হিসাবে রাখে তা হলে অন্য সকলের জিম্মাদারি আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই না রাখলে সকলেই ফরজ বর্জনের কারণে গোনাহগার হবে।
মুহাররম হিজরি সনের প্রথম মাস। এ মাসের বিশেষ ফজিলতের কথা হাদিসে এসেছে। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, রমজানের রোজার পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। -সহীহ মুসলিম : ২৮১২
রমজানের রোজা ফরজ। ফরজ রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত সবচেয়ে বেশি। রমজান ছাড়া বছরের অন্য মাসে নফল রোজা রাখা যায়। তো এ হাদিসে অন্য যেকোনো মাসে নফল রোজা রাখার চেয়ে মুহাররম মাসে নফল রোযা রাখা সবচেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। এ হাদিসে দিন-তারিখ নির্ধারিত করা হয়নি। মুহাররম মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিদিনের রোজাই সর্বোত্তম।
হযরত আলী রাযি.-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন?
তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল, রমজানের পর কোন মাসে আপনি আমাকে রোজা রাখার কথা বলেন? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তাহলে মুহাররম মাসে রাখো। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন। -জামে তিরমিযী : ৭৪১
মহররমের পুরো মাসের রোজাই সর্বোত্তম হলেও মহররমের ১০ তারিখের রোজা সবচেয়ে উত্তম এবং ফজিলতও অনেক বেশি। হাদিসে তওবা কবুলের দিন বলে আশুরার দিন বোঝানো হয়েছে। অপর এক হাদিসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি। -সহীহ বুখারী : ১৯০২
আশুরার রোজার বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আশুরার রোজা সম্পর্কে আমি আশাবাদী, তা পূর্বের এক বছরের গোনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। -সহীহ মুসলিম : ২৮০৪
আশুরার রোজার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, শুধু আশুরার দিনে রোজা না রাখা; বরং এর আগে নয় তারিখেও রোজা রাখা। কারণ, এ দিনটিতে ইহুদিরাও রোজা রাখত। যেমন হাদিসে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার রোজা রাখে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন, এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোজা রাখছ?
তারা জবাব দিলো, এটা তো এক মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা আ. ও তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। ফলে মূসা আ. আল্লাহর শোকর আদায়ের লক্ষ্যে এ দিনে রোজা রেখেছেন। তাই আমরাও রোজা রাখি।
(এ কথা শুনে) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হযরত মূসা আ.-এর অনুসরণ ও অনুকরণের জন্য তোমাদের চেয়ে আমরাই বেশি উপযুক্ত। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদিনে রোজা রেখেছেন এবং সাহাবীদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। -সহীহ মুসলিম : ২৭১৪
কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. এরই অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তীকালে আশুরার দিনের সঙ্গে ৯ তারিখের
রোজা রাখার কথা বলেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার দিনে রোযা রাখলেন এবং
সাহাবীদেরও রোযা রাখার আদেশ দিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন, এটা তো এমন দিন যাকে
ইহুদি ও নাসারারা খুবই সম্মান করে।
এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তা হলে ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা (১০ তারিখের
সঙ্গে) নয় তারিখেও রোজা রাখব। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, তবে
পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ইন্তেকাল করেন। -সহীহ মুসলিম : ২৭২২
এ হাদিস থেকে বুঝে আসে, আশুরার রোজা রাখার ক্ষেত্রে সুন্নত হলো, ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখেও রোজা রাখা। তবে অপর হাদিসে আশুরার আগে একদিন বা পরে একদিন রোজা রাখার কথা এসেছে। সে হিসাবে ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রেখে নিলেও হবে। তবে ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখাই সবচেয়ে উত্তম। কোনো কারণে ৯ তারিখ ছুটে গেলে ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রেখে নেবে।
মুহাররম মাসকে শাহরুল্লাহ আল্লাহর মাস বলা হয়েছে। এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা চাই। নফল ইবাদতের মধ্যে এ মাসে নফল রোজার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বিশেষত আশুরার রোজা। এ ছাড়াও একটি আমলের কথা পাওয়া যায় তা হলো, আশুরার দিন নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম খাবারের আয়োজন করা। ইফতার ও খাবারে যথাসম্ভব ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা। যে ব্যক্তি এ কাজ করবে আল্লাহ তায়ালা পুরো বছর তার জন্য প্রশস্ত রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। এ বিষয়টি এক হাদিসে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।