বাংলাদেশের একটি অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহি জেলা পাবনা। অতীতে সিরাজগঞ্জ ও পাবনা সদর মহকুমা মিলে মোট ১৭ টি থানা নিয়ে পাবনা জেলা হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৯৮৪ সালের ১ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ একটি পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
তদানিন্তন পাকিস্তান আমলে পাবনা জেলা ছিলো উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার। পাবনার নগরবাড়ি ঘাট যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে এবং পুর্বে মানিকগঞ্জ জেলার আরিচা ঘাট ছিলো রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সড়কপথ। বলতেগেলে সেসময় উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জেলাসমুহের মানুষের ঢাকা যাতায়াতের একমাত্র পথই ছিলো এটি। তখন পাবনা জেলার নগরবাড়ি ঘাট ছিলো সর্ববৃহত ফেরিঘাট। উত্তরবঙ্গের বাস নগরবাড়ি ফেরিঘাট পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরত যেতো। যাত্রীসাধারণ বাস থেকে নেমে ফেরি, লঞ্চ অথবা নৌকাতে যমুনা নদী পার হয়ে আরিচা ফেরিঘাটে পৌঁছতো। তখন সরাসরি ঢাকা পর্যন্ত বাস চলাচলের ব্যবস্থা ছিলোনা। তাই আরিচা ঘাট হতে লক্কর ঝক্কর মার্কা বাসে চড়ে তরাঘাট পর্যন্ত যাওয়া যেতো। এরপর দেশিয় নৌকা ফেরিতে পার হয়ে আবার নয়ার হাটে গিয়ে একইভাবে নদী পার হয়ে সাভারের কাছে গিয়ে থামতে হতো। সেখান থেকে আবার কয়েকটি নদী নৌকার ফেরিতে পার হয়ে তবেই ঢাকা পৌঁছানো যেতো। তখন রাস্তা ঘাট ছিলো সরু ও বেশিরভাগ রাস্তাই কাঁচা।
১৯৭০সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশনে জাতির উদ্দেেেশ্য ভাষণদান কালে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা হিসেবে যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা এগুতে পারেনি।
পরবর্তীকালে তাঁরই আহবানে সাড়া দিয়ে তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি একত্রিত হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এভাবে চলতে চলতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সকলকে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার উদাত্ত আহবান জানান। তিনি তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, “তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দিবে। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলে¬ন, তোমরা আমার ভাই তোমরা ব্যারাকে থাকো। আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করোনা। ভাল হবেনা। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্ল¬াহ। তিনি আরো বলে¬ন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ”
এরপর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। তাদের সাথে যোগ দেয় এদেশীয় রাজাকার আলবদর আল শামস বাহিনী। বাংলার স¦াধীনতকামি মানুষ বর্বর পাকিস্তনি হায়েনাদের বিরুদ্ধে জীবন মরণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলার পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পর গণমানুষের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের হাল ধরেন। সেসময় উত্তরবঙ্গবাসিদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে যমুনা নদীর উপর পুর্ব-প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে এজন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। যমুনা নদীর উপর সেতু নির্র্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ১৯৭৩ সালে যমুনা নদীর উপর একটি সড়ক-কাম রেল সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হাতে নেয়। কাজ এগিয়ে চলতে থাকে।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনৈতিক পটের আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রমত্তা যমুনা নদীর উপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু বহুমুখি সেতুর কাজ হাতে নেন এবং ১৯৯৮ সালে তা শেষ হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রি শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ২৩জুন তারিখে বঙ্গবন্ধু সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের ফলে সমগ্র দেশের জনগণ লাভবান হচ্ছে এবং এটি আন্ত:আঞ্চলিক ব্যবসায় ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপর্ণ ভুমিকা রাখছে। সড়ক ও রেলপথে দ্রুত যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ছাড়াও এই সেতু বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঞ্চালন এবং টেলিযোগাযোগ সমন্বিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এই সেতু এশীয় মহাসড়ক ও আন্ত:এশীয় রেলপথের উপর অবস্থিত। এ দুটি সংযোগ পথের কাজ সম্পন্ন হলে দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়া থেকে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিক সড়ক ও রেলপথ স্থাপিত হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রি শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করনের লক্ষে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরই উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর একটি বহুমুখি সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে লৌহজং, মুন্সিগঞ্জের সাথে শরিয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পুর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে ইতিহাসের একটি সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তর বিশিষ্ট ষ্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির উপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। ৬.১৫০মিটার দৈর্ঘ এবং ১৮.১০মিটার প্রস্থ পরিকল্পায় নির্মিত হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এধরনের দুঃসাহসিক কাজের গতিধারায় মুগ্ধ হয়ে ঐতিহ্যবাহি পাবনা জেলাসহ আশেপাশের জেলা সমুহের সার্বিক উন্নয়নে রেল সংযোগসহ ঢালার চর/ কাজিরহাট (পাবনা)-দৌলদিয়া (রাজবাড়ি)-আরিচা (মানিকগঞ্জ) ত্রিমুখি দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের আশায় বুক বেধে এসকল অঞ্চলের সাধারণ মানুষ আশান্বিত। এবিষয়ে উক্ত এলাকার অগণিত জনগণ একত্রিত হয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নিকট তাদের দাবী পেশ করার বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত। পাবনা জেলার ৯টি উপজেলার প্রায় প্রতিটি জায়গার জনসাধারণের একই দাবি দ্বিতীয় পদ¥া সেতুর বাস্তবায়ন চাই।
এই দাবির পক্ষে জোরালো যুক্তি হলো, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রি শেখ হাসিনা পাবনাবাসির অনেক দাবি ইতোপুর্বে পুরণ করেছেন। পাবনা মেডিকেল কলেজ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন একাডেমী, ঈশ্বরদী ইপিজেড, ঈশ্বরদী হতে ঢালারচর পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ ও ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করণ । সর্বপোরি পাবনার পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে ২হাজার ৪শত মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পরিকল্পিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা বাংলাদেশের একটি মেগাপ্রকল্প। যা নাকি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। কারণ রাশিয়াসহ দেশী-বিদেশী হাজার হাজার কর্মকর্তা কর্মচারি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের সাথে জড়িত। তাদের জন্য রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত বর্তমানে খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে সাধারণ নাগরিকসহ সকল্রে জন্যই তা কল্যাণ বয়ে আনবে।
দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের দাবিতে গত ৩০ আগষ্ট-২০১৯, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১ পাবনা জেলা শাখা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা জেলা শাখার উদ্যোগে পাবনা প্রেসক্লাবের সামনে বিশাল মানব বন্ধন কর্মসুচি পালিত হয়।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও পাবনা জেলা শাখার সভাপতিবীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম পাকনের সভাপতিত্বে ও জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক সাংবাদিক শফিক আল কামালের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১ পাবনা জেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতিও সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু,শহীদ সরকারি বুলবুল কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর কেবিএম নিশানুল হাবিব, শহীদ এম মনসুর আলী কলেজের অধ্যক্ষআব্দুস সামাদ খান, দৈনিক সিনসা পত্রিকার সম্পাদক ও ইছামতি নদী উদ্ধার আন্দোলন পাবনার সভাপতিএএম মাহবুব আলম, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম- মুক্তিযুদ্ধ ৭১ পাবনা জেলা শাখার আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দেওয়ান মজনুল হক, সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাব পাবনার সভাপতিড. মনসুর আলম, জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতিহাবিবুর রহমান জাবিব, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ফোরকান আলী, শহীদ আহম্মদ রফিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলেনা খাতুন, সেলিম নাজির উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকহাসিনা আক্তার রোজি, জেলা ছাত্র লীগের সাাবেক সভাপতি আহম্মেদ শরীফ ডাবলু প্রমুখ বক্তব্য দেন। বক্তারা বলেন, পাবনাসহ আশপাশের জেলাসমুহের সার্বিক উন্নয়নেও রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করতে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর বিকল্প নেই। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।