নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁর মহাদেবপুরে একের পর এক সাংবাদিকের উপর হামলার ঘটনা ঘটছে। গত পাঁচ বছরে এ উপজেলায় প্রায় ১০ বার সাংবাদিকের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এক প্রকার ঘোষণা দিয়েই প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা কিছু দুষ্কৃতীকারীরা হামলা করছেন। হামলার পর থানা পুলিশকে অবগত ও মামলার জন্য অভিযোগ করা হলেও বিষয়টি আমলে নেয়া হয়না। প্রভাবশালীদের চাপের কারণে পুলিশ এমনটা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, সাংবাদিকরা অনিয়ম ও দূর্নীতির সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ করা নিয়ে হুমকির মধ্যে থাকে। গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ বার সাংবাদিকে মারপিট করা হয়েছে। জেলার মধ্যে বালুমহল এলাকা এ উপজেলা। এখানে আত্রাই নদী থেকে নীতিমালা উপেক্ষা করে অবৈধ্য খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। আত্রাই নদীর বালুমহল ছাড়াও প্রভাবশালীরা অন্য স্থান থেকে জোরপূর্বক বালু উত্তোলন করে। এতে করে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের কংক্রিটের বøক (সিসি), নদীর আশপাশে ফসলি জমি, বসতবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।
বালু খেকোরা বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো বালু উত্তোলন করে। স্থানীয়রা বাঁধা দিতে গেলে মামলা দিয়ে হয়রানি করার ভয়ভীতি দেখানো হয়। সাংবাদিকরা এসব অনিয়ম নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে বালু খেকোরা বাঁধা প্রদান করেন এবং সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য হুমকিও দেন। এক কথায় বালু খেকোরা পূর্ব ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের মারপিট করে থাকেন। আর এর মুলে থাকে সরকার দলীয় কিছু প্রভাবশালীরা। তাদের ছত্রছায়ায় থাকে কিছু পেটোয়া বাহিনী। সময় সুযোগ বুঝে তারা সাংবাদিকদের হামলা করে থাকে। সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও পুলিশের কাছ থেকে তেমন কোন সহযোগীতা পাওয়া যায়না। প্রভাবশালীদের চাপের মুখে থানা পুলিশ নীরব ভ‚মিকা পালন করেন। পুলিশের নীরব ভ‚মিকার কারণে প্রভাবশালীরা আরো বেপারোয়া হয়ে উঠেন। সাংবাদিকরা বিচার না পাওয়ায় তারা আবারও সাংবাদিকদের পেটানোর সাহস পান।
বালু মহল নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে গত ৫ আগষ্ট মহাদেবপুর উপজেলা ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার প্রতিনিধি ইউসুফ আলী সুমন এবং ‘দুরন্ত সংবাদ’ এর প্রতিনিধি আমিনুর রহমান খোকনকে রাস্তায় পরিকল্পিত ভাবে মারপিট করেছে বালু খেকোরা। ঘটনায় ইউসুফ আলী সুমন বাদী হয়ে গত ৯ আগষ্ট উপজেলার মহিষবাথান ঘাটের বালু ব্যবসায়ী হেলাল সরদার, মতিন এবং রাসেল সহ অজ্ঞাত ৫-৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর পুলিশ কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। এ নিয়ে নানান তালবাহানা শুরু করে থানা পুলিশ। বিষয়টি ভিন্ন খাতেও প্রবাহের চেষ্টা করা হয়। থানায় অভিযোগ করার ১৭দিন পর গত ২৫ আগষ্ট মামলা আকারে রেকর্ড করা হয়।
বালু মহল সহ এ উপজেলার অনিয়ম ও দূর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করায় গত ২৪ আগষ্ট বদলগাছী-মহাদেবপুর উপজেলার কালের কন্ঠের সাংবাদিক এমদাদুল হক দুলুকে হত্যার উদ্যেশের লোহার রড দিয়ে মারপিট করা হয়। এতে তার ডান হাত ভেঙে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে থানার অফিসার ইনচার্জ গড়িমসি শুরু করেন। উপজেলার ‘জাহাঙ্গীরপুর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান সাজুর’ নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অবশেষে মামলাটি গ্রহন করলেও আসামীকে এখনো আটক করা হয়নি।
নির্যাতিত সাংবাদিক এমদাদুল হক দুলু বলেন, ‘আমি বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখালেখি করি। একটি প্রভাবশালী মহল চক্রান্ত্র করে আমার উপর হামলা করতে পারে। থানায় মামলা দায়েরে ৪দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ আসামীদের এখনো আটক করছেন না।
মহাদেবপুর উপজেলার সিনিয়র সাংবাদিক আক্কাস আলী বলেন, সাংবাদিকরা নির্যাতনে শিকার হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে ঐক্য না থাকা। আমাদের মধ্যে যদি ঐক্য থাকত তাহলে আমরা নির্যাতনে শিকার হওয়ার কোন ঘটনা ঘটত না। যারা সাংবাদিকদের নির্যাতন করেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।
নওগাঁ সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক আজাদ হোসেন মুরাদ বলেন, সাংবাদিকরা যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তার মানে এই নয় যে, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সাংবাদিকদের মারপিট করতে হবে। আবার সাংবাদিকদের উপর কোন হামলার ঘটনা ঘটলে পুলিশ প্রশাসন তেমন সহযোগীতা করে না। অর্থ্যাৎ নিরব ভ‚মিকা পালন করে। যার কারণে প্রভাবশালীরা আরো বেপারোয়া হয়ে উঠে। সাংবাদিকদের উপর যারা হামলা করেছে অবিলম্বে তাদের দ্রæত আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থার দাবী জানান তিনি।
এ ব্যাপারে মহাদেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, সাংবাদিক এমদাদুল হক দুলু যে মামলা করেছেন তার আসামী এখনও আটক করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া সাংবাদিক ইউসুফ আলী সুমনের মামলাটি অনেক দেরীতে রেকর্ড করা হয়েছে। সাংবাদিকরা কিছু ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও হামলার শিকার হয়ে থাকেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন রেজা বলেন, এটির দুটো দিক আছে। যার একটি আইনগত ব্যবস্থা। যারা অপরাধি তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। অপরটি হচ্ছে- সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার যে প্রয়াস সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে সাংবাদিক নেতাদেরও স্বোচ্ছার হতে হবে। বিগত দিনের দূর্বলতার কারণে বাব বার সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ ভ‚মিকা না রাখা ও দূর্বলতার কারণে পরবর্তীতে দুষ্কৃতিকারীরা হামলা করার সাহস পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।