পাবনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
১৯৫৩ থেকে ১৯৭৩ সাল। এই ২০ বছরে বঙ্গবন্ধু প্রায় ১০ বার পাবনা সফরে এসেছিলেন। কখনো সাংগঠনিক সফরে, কখনো নির্বাচনী সফরে। কখনো এসেছেন রাষ্ট্রীয় সফরে। কখনো এসেছেন আনন্দ চিত্তে, কখনো এসেছেন ব্যথা আর বেদনা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু পাবনাকে ভালবাসতেন – ভালবাসতেন পাবনার মানুষকে। পাবনায় তাঁর একমাত্র ছোট ভাই শেখ নাসের এর শ্বশুর বাড়ী। পাবনায় একাধিক জন ছিলেন, তাঁর শিক্ষা জীবনের সহপাঠী, বাল্যবন্ধু এবং রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। ছাত্র নেতা থেকে শ্রমিক নেতা, যুব নেতা, জননেতা সহ শতাধিক নেতাকে নাম ধরে ডাকতেন। নিজ দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি সহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ঘনিষ্ঠতা। পাবনার সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, গুনীজন কেউ বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা থেকে বাদ পড়েন নাই। যা তাঁর কথায়, লেখায় এবং বক্তৃতায় উঠে এসেছে।

১৯৫৩ সালে তরুন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পাবনায় এলেন সাংগঠনিক সফরে। সাথে প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান । পাবনায় সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে মত বিনিময় করেন। অনেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিপক্ষে আওয়ামী লীগে যোগ দেবার প্রস্তাবে মত বা সাড়া দিলেন না। আবার অনেকেই মত এবং সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন। যোগ দিলেন পাবনা উকিল বারের তরুন আইনজীবি ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, সৈয়দ ফজলে এলাহী আব্দুর রব বগা মিয়া, তৎকালীন এডওয়ার্ড কলেজের ভিপি আব্দুল মমিন তালুকদার প্রমুখ। শুরু হলো পাবনায় আওয়ামী লীগের নব যাত্রা।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২য় বার পাবনা সফরে এলেন। সেই সফরে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পাবনায় এসেছিলেন। উল্লেখ্য সেই নির্বাচনে পাবনা সদর থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা বানু প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। উক্ত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তাঁরা সরকার গঠন করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হয়েছিলেন।

১৯৬২ সালে ১৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনার ঈশ্বরদীতে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের প্রচারনা সভায় এসেছিলেন। সেই সভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হোসেন সরকার, শাহ আজিজুর রহমান সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন। সেই নির্বাচনে পাবনা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ আমজাদ হোসেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য ( এম,এন,এ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐ একই বছরের ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আবার পাবনা সফরে এসেছিলেন। সেবার পাবনা স্টেডিয়ামে বিশাল জনসভায় ভাষন দিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালের ৯ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবার পাবনায় এসেছিলেন। সেবার প্রধান অতিথি হিসেবে পাবনা টাউন হল মাঠে জনসভায় ভাষন দিয়েছিলেন।

১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে পুর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবীতে ৬ দফা পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষনার সাথে সাথে তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান এবং তাঁর সরকারের টনক নড়ে উঠে। পুর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ ১১ দফা ঘোষনা করে। তৎকালীন আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ছাত্রলীগের ১১ দফা ঘোষনার পর পুর্ব বাঙলার ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারন মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনা সফরে আসেন। ঐদিন নগরবাড়ী ঘাটে হাজার হাজার জনতা বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা প্রদান করে পাবনা শহরে নিয়ে আসেন। বিকালে পাবনা টাউন হল মাঠে বিশাল জনসভা। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ আমজাদ হোসেন এর সভাপতিত্বে এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার পরিচালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। সেদিন বঙ্গবন্ধু হাজার হাজার জনতার সামনে প্রথম ৬ দফা ঘোষনা করেন। পাবনার মানুষ মুহুমুহু করতালির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষনার প্রতি হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছিলেন। পাবনায় ৬ দফা ঘোষনার কয়েকদিন পরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল । পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে বিচার শুরু করেছিলেন। পাকিস্তানী শাসকরা চেয়েছিল দ্রুত বিচার কাজ সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করবেন। কিন্তু সেটা তারা সফল হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর থেকে দেশে বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। দেশেও শুরু হয় তীব্র গন আন্দোলন। অবশেষে ৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানা থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পরই ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্র জনতার সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধীতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭০ সালে ২৯ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবার পাবনা সফরে আসলেন। তবে এবার পাবনা শহরে নয়। বেড়া কলেজ মাঠে বিরাট জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষন দিয়েছিলেন। ঐদিন বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে নগরবাড়ী ঘাটে হাজার হাজার জনতা জমায়েত হয়ে তাঁকে বরন করেছিলেন। ঐ একই বছরের জুন মাসের দিকে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন পূর্ব প্রচার অভিযানে পাবনা এসেছিলেন। সেই সফরে কেন্দ্রীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মুনসুর আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে খোলা জীপ গাড়ীতে চড়ে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা এসেছিলেন। পথিমধ্যে দাশুড়িয়া, টেবুনিয়া, এডওয়ার্ড কলেজ গেটে পথসভা করে পাবনা টাউন হলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেবার পাবনা পৌরসভা সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ আমজাদ হোসেন এর বাড়ীতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে বৈঠক করেন এবং শালগাড়ীয়া মহল্লায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার বাড়ীতে খাওয়া দাওয়া করেছিলেন। ৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেষ বার পাবনায় এলেন ২৫ ডিসেম্বর ব্যথিত এবং শোকার্ত হৃদয় নিয়ে। ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সাঁথিয়া-বেড়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ( এম,পি,এ) আহমেদ রফিককে ২২ ডিসেম্বর রাতে পাবনা শহরের দক্ষিণ রাঘবপুর মহল্লায় তাঁর বাসভবনের সামনে তথাকথিত নক্সাল বাহিনী ছুরিকাঘাতে খুন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ ডিসেম্বর পাবনায় আসেন। নিহত আহমেদ রফিক এর বাসভবনে গিয়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।আরিফপুর কেন্দ্রীয় গোরস্থানে গিয়ে মরহুমের কবর জিয়ারত করেন। এরপর পাবনা পুলিশ লাইন মাঠে শহীদ আহমেদ রফিক এর স্মরনে শোক সভায় বক্তব্য দিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পাবনা ত্যাগ করেন।

১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ২ মাস ১০ দিন পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনা সফরে এলেন। ঐ দিন নগরবাড়ীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ( মুজিব বাঁধ) এর উদ্বোধন করলেন। হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তব্য রাখলেন। সেদিন বক্তব্যে বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা আমার মেয়ে। এখন থেকে তোমরা পিতা হিসেবে আমার নাম লেখবে। তোমাদের সম্মান হবে সবার উপরে। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ মে দুইদিনের জন্য পাবনা সফরে এলেন। ঐদিন সকালে হেলিকপ্টারে পাবনা স্টেডিয়ামে অবতরন করেন। হাজার হাজার মানুষের সাথে কর্মমোদন করেন। তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয় ( সংযুক্ত ছবিতে ঐদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাল্যদান করছেন লেখক আমিরুল ইসলাম রাঙা)। বঙ্গবন্ধুকে সর্বস্তরের জনগন সংবর্ধনা জানান। পুলিশ, আনসার, আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করেন। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে পাবনা সার্কিট হাউসে অবস্থান করেন। সন্ধ্যায় পাবনা বনমালীতে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পরেরদিন তিনি পাবনা ত্যাগ করেন।

১৯৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ পাবনা সফর। এদিন তিনি শিশুর মত কাঁদতে কাঁদতে পাবনা শহরে প্রবেশ করেছিলেন। পাবনায় তাঁর শেষ প্রিয়জন – শেষ আপনজন – শেষ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা আব্দুর রব বগা মিয়া মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন । ৭৩ এর ৭ মার্চ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ১২ দিন আগে পাবনা সদর আসনের প্রার্থী আব্দুর রব বগা মিয়া নির্বাচন প্রচারনায় বের হলে সড়ক দুর্ঘটনায় কবলিত হন এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরন করেন। উনার মৃত্যু বরন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোর গনভবনে অবস্থান করেছিলেন। তিনি দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাবনায় ছুটে আসেন এবং নিহত আব্দুর রব বগা মিয়ার মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পাবনায় ২ বছরের ব্যবধানে তাঁর প্রিয় চার শীর্ষ নেতাকে হারিয়ে সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।

এর ২ বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে গোটা জাতিকে বাকরুদ্ধ করেছিলেন । জাতীয় শোক দিবসের উষালগ্নে এই মহান নেতার স্মৃতিচরণে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। মহান নেতা অমর হোক। জয় বাংলা – জয় বঙ্গবন্ধু ??

( সমাপ্ত )

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
১৪ আগষ্ট ২০১৮

তথ্য সুত্র –
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ” অসমাপ্ত আত্মজীবনী।
২. ড. এম আব্দুল আলীম ( সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)
৩. শেখ মোহাম্মদ সুমন, তরুন গবেষক, নীলমন গ্যালারী।