জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ খুনিকে আজও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। পলাতক খুনিদের ছয়জনকে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও তাদের কে কোন দেশে পালিয়ে রয়েছেন, সবার সেই তথ্য এখনও জোগাড় করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
এই ছয়জন হলেন, খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান।
পলাতক এই ছয়জনের বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিস জারি করা আছে। ২০০৯ সালে এই নোটিস জারির পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে।
এই ছয়জনের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)’র সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা মহিউল আলম।
তিনি বুধবার (১৪ আগস্ট) জিজ্ঞাসায় বলেন, নূর চৌধুরীর কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের অবস্থান কোথায়, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
নূর চৌধুরী কানাডায় থাকলেও ফাঁসির আসামি বলে তাকে ফেরত দিতে অনীহা দেখিয়ে আসছে দেশটির সরকার; যদিও তাকে ফেরত পেতে বারবার দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
রাশেদ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ তাকে ফেরত চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র তা এড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডে এক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে বলেন রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করতে।
মোমেনের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন পম্পেও উল্টো জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ কাকে চায় রাশেদ চৌধুরী না কি ডেভিড ওয়াটসনকে। অর্থাৎ রাশেদ চৌধুরী নাম পাল্টেও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে থাকতে পারেন।
মাজেদ ও মোসলেম উদ্দিনের ব্যাপারে এনসিবি’র কর্মকর্তা মহিউল জানান, সর্বশেষ এই দুজনের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানে বলে শোনা যাচ্ছিল। তখন দুই দেশকে চিঠিও দেওয়া হয়।
ভারত জবাবে বলেছে, তাদের দেশে নেই। পাকিস্তান কোনো জবাব না দেওয়ায় রিমাইন্ডার দেওয়ার পরও কোনো উত্তর মেলেনি। ফলে তাদের অবস্থান এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
রশিদ ও ডালিমের অবস্থানের বিষয়েও স্পষষ্ট তথ্য নেই।
মহিউল বলেন, রশিদের ব্যাপারে সম্ভাব্য যে সব দেশের নাম শোনা যাচ্ছে, তা হচ্ছে ফ্রান্স, ইতালি, লিবিয়া, পোল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। আর ডালিম চীন, ইংল্যান্ড, হংকং, কেনিয়া, লিবিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে কোনো এক দেশে আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।
প্রতিটি দেশে চিঠি পাঠিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হলেও তার কোনো জবাব এখনও মেলেনি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
মহিউল বলেন, ইন্টারপোল সব ধরনের সহযোগিতা করছে। এই পলাতকরা তাদের বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এক দেশে থেকে অন্য দেশে যে কোনো বন্দর দিয়ে যেতে চাইলে তাকে সংশ্লিষ্ট দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করবে, এই ব্যবস্থাও করা আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীকে সামনে রেখে পলাতক খুনিদের দুই-একজনকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের আশাবাদ প্রকাশ করে আসছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।
তবে এক্ষেত্রে জটিলতার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন, পঁচাত্তরের ট্রাজেডির পর ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এই খুনিরা দেশ ছাড়ার সময় একাধিক পাসপোর্ট করেছিলেন।
জাতির জনকের খুনিদের ফেরাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেছিলেন, কোনো খুনির বাসার সামনে প্রবাসীরা বিক্ষোভ করলে সে দেশের সরকারও চাপের মধ্যে থাকবে।
এই ছয়জনের পাশাপাশি আরও এক খুনিও বাংলাদেশের খাতায় পলাতক। তবে সেই আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। তারপর বিচারের পথও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বিচারের পথ খোলে; মামলার পর বিচার শুরু হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যাওয়ার পর ফের শ্লথ হয়ে যায় মামলার গতি।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দণ্ডিত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি)।
এরপর থেকে পলাতক খুনিদের অবস্থান শনাক্ত করে দেশে ফেরানোর চেষ্টা চললেও তারা এখনও অধরাই রয়ে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিবরণ অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নূর চৌধুরী ও মেজর বজলুল হুদা সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। বজলুল হুদার মৃত্যুদণ্ডাদেশ ইতিমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে। নূর চৌধুরী এখনো পলাতক রয়েছেন। অপর পলাতক আসামিদের মধ্যে সাবেক সেনা ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ভারতে পলাতক রয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে কোনো সঠিক সরকারি তথ্য নেই। অপর পলাতক আসামিরা হলেন‒বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ এবং শরিফুল হক ডালিম। ঢাকায় পররাষ্ট্র দপ্তর এর আগে পলাতক আসামিদের মধ্যে জিম্বাবুয়ে একজন বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল আজিজ পাশার স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করে।
১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ী হবার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করে। এই কালো আইনের জন্য এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। সর্বোচ্চ আদালত আপিল ডিভিশনের রায়ের পর ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হলো সাবেক লে. কর্নেল ফারুকুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) শাহরিয়ার রশীদ খান এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) ও সাবেক মেজর বজলুল হুদা। ঢাকা ও ব্যাংককের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরের পর হুদাকে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে প্রত্যাবাসন চুক্তি না হলেও সাবেক সামরিক সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে দেয়।
১৯৭৫ পরবর্তী সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন মিশনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তারা নানা ষড়যন্ত্র ও দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় ফিরে এসে কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের পথ প্রশস্ত হয়।
খুনি লে. কর্নেল রাশেদ চৌধুরী ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় কনস্যুলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সর্বশেষ বদলি হয় টোকিওতে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করে।
রিসালদার মোসলেউদ্দিনকে তেহরান ও জেদ্দায় পোস্টিং দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম অটোয়ায় এবং লে. আব্দুল মজিদ ত্রিপোলিতে কূটনীতিক হিসেবে চাকরি পান।
লে. কর্নেল মো. আব্দুল আজিজ পাশা রোমে বাংলাদেশ মিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পান। আজিজ পাশা ১৯৮০ সালের ১৭ জুন অভ্যুত্থান ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকায় গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে তিনি অভ্যুত্থান সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হওয়ায় সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয় তার। তাকে রোমে কূটনীতিকের চাকরি দেওয়া হয়। আজিজ পাশা নাইরোবিতেও দায়িত্ব পালন করেন। তার সর্বশেষ পোস্টিং ছিল জিম্বাবুয়েতে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পাশা জিম্বাবুয়েতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ২০০১ সালের ২ জুন তিনি মারা যান।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসার পর পাশাকে মরণোত্তর চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয় এবং তার পরিবারকে পেনশনসহ সকল সরকারি সুবিধা দেওয়া হয়। তাকে চাকরি থেকে অবসর দেখানো হয়।