আজ জাতীয় শোক দিবস : পাবনায় নানা কর্মসুচী গ্রহন

রফিকুল ইসলাম সুইট : কবির ভাষায়“এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমার পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।” আজ ১৫ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী। দিবসটি উপলক্ষে পাবনা জেলা প্রশাসন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যারয়, পাবনা জেলা আওয়ামীলীগ, পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ, সকল উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন নানা কর্মসচী গ্রহন করেছে।
৪৪ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই কালিমাময় দিনে জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানকে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য সর্বনাশা চক্রান্তে একদল ঘাতকের পৈশাচিকতার বলি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজন। রচিত হয় ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়।
বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু এক-অবিচ্ছেদ্য। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেয়া এক শিশু তরুণ বয়স থেকেই বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। শিক্ষা জীবন ও রাজনীতি চলে পাশাপাশি। বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭০ সহ বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর দ্বার হতে বারবার ফিরে এসেছিলেন তিন। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ট নেতৃত্ব এবং লাখো শহীদের রক্তে বিনিময় আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ বঙ্গবন্ধু নেই রযেছে তার প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরোধা পুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে তিনি মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করেন। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রণেতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবজ্ঞা পুরুষ বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সফল রূপকার। তার ৭ মার্চের ভাষণই ছিল গেরিলা যুদ্ধের কৌশল। একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৫০ দিনের মাথায় সে দেশ থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার ছিল একটি বিস্ময়কর ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞায় এবং দৃঢ় নেতৃত্বের কারণেই ১৯৭২ এর ১২ মার্চ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মধ্যে জাতিকে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেন। ১৯৭২এর ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হয়। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানুষের পরম বন্ধু। নিজ দেশের জনগণকে নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। জাতিসংঘ বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৭৩ সালে তাকে শান্তির জন্য জুলিও কুরি উপাধিতে ভূষিত করে। দ্রুততম সময়ে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বাংলাদেশ ১৪২টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ এবং ওআইসির সদস্য লাভ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু প্রথম বাঙালি যিনি একটি দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা অর্জনে সক্ষম হন।
‘৭১-এ পাকিস্তানি হায়েনারা যা করতে পারে নাই, সেই কাজটিই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে সম্পাদন করে পাপিষ্ঠ ঘাতকরা। ঘাতকদের মূল টার্গেট ছিল যে তারা বঙ্গবন্ধুসহ তার পুরো পরিবার ও তার নিকট আত্মীয় কাউকেই পৃথিবীতে জীবিত রাখবে না। সেই অনুযায়ী তারা সেদিন ওই ঘাতকরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হত্যার এক জঘন্য উলাসে মেতে উঠেছিল। হত্যা করেছিল বিভিন্ন ঘরে ও একাধিক বাড়ি হতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং নিকট আত্মীয়সহ মোট ২৬ জনকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালোরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক। প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি এবং বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় পৃথক হামলা চালায়। ঘাতকদের হাতে নিহত হন শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান। সেদিন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহেনা।
পঁচাত্তর পরবর্তী অবস্থাজাতির জনককে হত্যার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ ছিল তিমিরাচ্ছন্ন। দেশ পরিচালনার নেতৃত্ব গ্রহণ করে অনির্বাচিত সরকার। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন তাদেরও নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ‘৭২-এর সংবিধান সংশোধন করে চার-মূলনীতি পরিবর্তন ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকা- চালাতে সহায়তা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ১৫ আগস্টে জাতির জনকের সপরিবারে হত্যাই সব ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে। সেদিন দুগ্ধপোষ্য শিশু, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, প্রতিবন্ধী কেউই রেহাই পায়নি। হত্যাকান্ডে খুনিদের শান্তি নিশ্চিত না করে বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করার অপচেষ্টা হয়েছে। এমনকি খুনিরা পুরস্কৃতও হয়েছে নানাভাবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। ঘাতকরা যেন নিরাপদে হত্যাকান্ড ঘটাতে পারেন সে জন্য তিনি নীরবতা পালন করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। ইতিহাসের সব চেয়ে কলঙ্কময় এই ঘটনায় খুনিরা অত্যন্ত প্রতাপ নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। দীর্ঘদিন জাতিকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে এ খুনের কলঙ্ক। একটি রাষ্ট্রের স্থপতিকে সপরিবারে খুনের ঘটনার পর অপরাধীদের দাম্ভিকতা প্রদর্শন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দীর্ঘ সময় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে তাদের পরিবারের সব সদস্য হারানোর মর্মান্তিক বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতির কাছে পিতা, মাতা ও স্বজন হারানোর বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের কেউ তাদের মর্মবেদনায় কর্ণপাত করেনি। প্রতি পদে পদে খুনীদের দোসর ও মদদদানকারী সরকারের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালে আটকে থেকেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাযজ্ঞের বিচার। সময়ের পালাবদলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ হত্যাকান্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত করে। বাংলাদেশের স্থপতির নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার পেতে বাঙালী জাতিকে ৩৫টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ২০১০ সালের শুরুতেই ২৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে মানবতার শত্রু নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনীর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। পাঁচ খুনীর ফাঁসি হলেও আজও নেপথ্যের কুশিলবরা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাই এবারের শোক দিবসের সর্বত্র একই আওয়াজ- শুধু খুনী নয়, নেপথ্যের কুশিলবদেরও দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
দিবসটি উপলক্ষে পাবনা জেলা প্রশাসন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যারয়, পাবনা জেলা আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠন (মাস ব্যাপী), পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ(৩ দিন ব্যাপী), হাজী জসীম উদ্দীন কলেজ, শহীদ এম মনসুর আলী কলেজ, সকল উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ ধারণ, শোক র‌্যালী, রচনা প্রতিযোগীতা, উন্নত খাবার পরিবেশন, দোয়া খানী, রক্তদান, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসচী গ্রহন করেছে।