বিভক্তির পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর। বিশেষ মর্যাদা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার একদিন পরও রাজ্যটি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। যদিও কাশ্মীরে অবস্থান করা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল জানিয়েছেন, পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক। কাশ্মীর সংক্রান্ত বিল গতকাল লোকসভায়ও পাশ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীরিদের অধিকার রক্ষার আহবান জানিয়েছে। চীন লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার বিরোধিতা করেছে। তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, কাশ্মীরিদের খাদের কিনারায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর পাকিস্তান ভারতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বিচ্ছিন্ন কাশ্মীর
রাজ্যের টেলিফোন, মোবাইল এবং ইন্টারনেটের সংযোগ রবিবার সন্ধ্যায়ই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। গতকাল পর্যন্ত সেগুলো ঠিক হয়নি। রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর ব্যাপক বিক্ষোভের আশঙ্কা ছিল। তবে সেখানকার মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু জানা যাচ্ছে না। দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রীসহ স্থানীয় নেতাদের এরই মধ্যে আটক করা হয়েছে। ভারতের অন্যান্য স্থানে থাকা কাশ্মীরিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। দিল্লিতে থাকা এক ছাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, তিনি স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিলোপের ঘোষণা দেওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। অতিরিক্ত দশ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কোনো পরিকল্পনা সম্পর্কে ইঙ্গিতও দেওয়া হয়নি। স্থানীয়রা খারাপ পরিস্থিতির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কয়েক মাসের খাবার মজুদ করে রাখেন। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে ধারণা করে পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য স্যাটেলাইট ফোন বরাদ্দ করা হয়।
লোকসভায়ও পাশ
সোমবার রাজ্যসভার পর ‘জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন সংক্রান্ত বিল-২০১৯’ গতকাল লোকসভায়ও পাশ হয়েছে। বিলটির পক্ষে ৩৬৬ এবং বিপক্ষে ৬৬ ভোট পড়ে। কিছু বিরোধী দল ওয়াক আউট করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই বিলটি পাশ হয়। এর ফলে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হবে।
আদালতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভিন্ন মত
সংবিধান বিশেষজ্ঞ এজি নুরানি বলেন, এটা সম্পূর্ণভাবে অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত। ৩৭০ ধারার আইনী দিকটা পরিষ্কার। কেউ এর বিলোপ ঘটাতে পারে না। ওই অধিকার কেবল জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান সভার। কিন্তু সেটা তো ১৯৫৬ সালেই ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ভারতের সাবেক অতিরিক্তি সলিসিটর জেনারেল বিকাশ সিং ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপ মনে করেন, ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার নিয়ে আদালতে আবেদন জানানো সম্ভব নয়। তাদের মতে, সরকার সংবিধান মেনেই ৩৭০ এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মনে হয় না এটাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। বিকাশ সিং বলেন, ওই দুটি অনুচ্ছেদেই অস্থায়ী ব্যবস্থার বিষয়ে বলা ছিল। সরকার সেই অস্থায়ী ধারা দুটি সরিয়ে দিয়েছে। এখন জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকদের সেসব মৌলিক অধিকার থাকবে যা ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী অন্যসব রাজ্যের নাগরিকদের আছে।
পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ
মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, কাশ্মীর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত ডোভালের পাঠানো রিপোর্টে জানা গেছে, কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষও সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। কোনো বিক্ষোভ-প্রতিরোধের ঘটনা নেই এবং সাধারণ মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন কাজ করছেন। যদিও ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর নতুন করে অশান্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকার। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় অজিত দোভাল কাশ্মীরেই অবস্থান করবেন বলে ধারণা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মর্গান ওরটাগাস কাশ্মীরিদের অধিকার রক্ষার আহবান জানিয়েছেন। দেশটি বিশেষ মর্যাদা বাতিল করায় যাদের ওপর প্রভাব পড়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের প্রতি আহবান জানিয়েছে। তিনি জানান, ভারত এই বিষয়টিকে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে উল্লেখ করেছে। চীন লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার বিরোধিতা করেছে। তবে ভারত এবং পাকিস্তানকে কোনো ধরনের উত্তেজনা থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছে।
ব্রিটেন ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যমানেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে ভারতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, এতে সহিংসতা বাড়তে পারে। গত কয়েক দিনে কাশ্মীরিদের খাদের কিনারায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গতকাল পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে বলেছেন, আমরা বর্ণবাদী আদর্শের মোকাবেলা করছি। তিনি ভারতের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানান এবং সারা বিশ্বকে জানাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে উল্লেখ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, কাশ্মীরে জনসংখ্যার মানচিত্রে পরিবর্তন আনতেই ভারতের এই পদক্ষেপ। এর আগে সোমবার ইমরান খান কয়েকটি দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। দেশটির এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানায়, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ইমরান খানকে সমর্থন জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
গতকাল লোকসভা কাশ্মীর ইস্যুতে উত্তপ্ত ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বিরোধী কংগ্রেসসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের বাকবিত্লা হয়। কংগ্রেসের এক প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্ধ হয়ে অমিত শাহ বলেন, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরও আমাদের, আকসাই চীনও আমাদের। তিনি বলেন, গোটা দেশে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পার্লামেন্টের আছে। দেশের সংবিধান ও জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধানেও সেটা উল্লেখ আছে। অমিত শাহের বিলের বিরোধিতা করে তৃণমূল এমপি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে দেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, রাজ্যটিকে কেন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে? কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি বলেন, বিধানসভার অনুমতি ছাড়া ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করা যায় না। সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। তিনি জানান, সংবিধানের আরো নানা অনুচ্ছেদে নাগাল্যান্ড, আসাম, মণিপুর, সিকিম এবং অন্ধ্রপ্রদেশকে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে কি সেই রাজ্যগুলোকেও ভিন্ন বার্তা দেওয়া হচ্ছে? গতকাল টুইটার বার্তায় কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী বলেন, সংবিধানকে লঙ্ঘন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জেলে পুরে ও জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখ্লিত করে জাতীয় সংহতিকে শক্তিশালী করা যায় না। কেবল কিছু জমির খ্ল দেশটাকে গড়ে তোলেনি, দেশটাকে গড়ে তুলেছেন নাগরিকরাই। প্রশাসনিক ক্ষমতার এই অপব্যবহার দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। তথ্যসূত্র : বিবিসি, এনডিটিভি, ডন ও আনন্দবাজার পত্রিকা