চলনবিল ভ্রমন

আমিরুল ইসলাম রাঙা

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি — গাঁয়ের মধ্যে কলম আর বিলের মধ্যে চলন। চলনবিল কতবড় তা বিলে বাস করা মানুষও বলতে পারবেনা। চার জেলার এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই বিলের অবস্থান। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও বগুড়া জেলার এক বিরাট অংশ জুড়ে এই বিল ছড়িয়ে আছে। আমাদের কিশোর বয়সের চলনবিল এক আতঙ্কের নাম ছিল। চারিদিকে পানি আর পানি। সেই পানিতে প্রতিবছর নৌকা ডুবে বহু মানুষ মারা যেত। বর্ষায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। ঢেউয়ের আঘাতে বাড়ীঘর ভেঙ্গে যেত। মানুষের চলাচল কমে যেত। শুষ্ক মৌসুমে রাস্তাঘাটের অভাবে চলাচল করা দুষ্কর হতো।এখন সেই প্রমত্ত চলনবিল পানির অভাবে তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। শ্রীহীন চলনবিল এখন আমাদের মত বৃদ্ধ, অচল এবং পানি শুন্য। চলনবিলে এখন বছরের বেশীর ভাগ সময় পানি থাকেনা। বিল এখন অনেকাংশে নদী নির্ভর হয়ে পড়েছে।

ইঠাৎ করেই সেই চলনবিল দর্শনের সিদ্ধান্ত হলো। পাবনার বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ এনামুল করিম হলো আয়োজক। তাঁর আমন্ত্রনে ঢাকা থেকে আসবে জাপান প্রবাসী ডাঃ শেখ আলীমুজ্জামান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডাঃ রওশন আনোয়ার , রাজশাহী থেকে আসবেন ডাঃ দেওয়ান নাজমুল আলম ( গামু)।

যথারীতি ২২ আগষ্ট সকাল ৭ টায় পাবনা থেকে মাইক্রোবাসে রওয়ানা দিলাম। পাবনা থেকে ডাক্তার সাহেবের সফরসঙ্গী হলাম আমি, এডঃ নাজমুল কাবী শিন্টু, হাবীব হাসান মনার, খোকন, এবং জহুরুল আলম সেলিম । পাবনা ক্যাডেট কলেজের পাশ দিয়ে আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত, ধানুয়াঘাটা হয়ে ফরিদপুর। বনওয়ারীনগর ফরিদপুর পর্যন্ত্য মাইক্রোবাস যেয়ে – সেখান থেকে নৌকায় যাত্রা শুরু হবে।

যাত্রার আধাঘন্টার মধ্যেই চলনবিল দর্শন শুরু হলো। আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত ইউনিয়ন থেকেই বিলের শুরু। লক্ষীপুর, ধানুয়াঘাটা, হাদল এলাকায় বড় বিলগুলিকে মনে হচ্ছে দিগন্তজোড়া বিল। কোন কোন জায়গায় এপার ওপার দেখা যায়না। ভাঙ্গুড়া উপজেলার দক্ষিণ অংশ হাটগ্রামকে স্থানীয় এলাকাবাসীতো পর্যটনকেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে। এখানে দুরদুরান্ত থেকে মানুষ আসে বিলদর্শন করতে। এছাড়া এখানে নৌকাবাইচের বড় আয়োজন করা হয়। আমরা এখানে নেমে কিছু সময় কাটালাম এবংবেশ কিছু ছবি তুললাম। দশমিনিটের যাত্রা বিরতি দিয়ে ফরিদপুর পৌছালাম সকাল সাড়ে আটটার দিকে।

উল্লেখ্য, এই ফরিদপুর উপজেলা সদরের কাশিপুর গ্রামে ডাঃ এনামুল করিমের জন্মভূমি ও পৈতৃিকভিটা। নাড়ীর টানে প্রতি শুক্রবার এখানে আসেন। তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ” ডাঃ আব্দুল গণি হেলথ কেয়ার ” এ সাপ্তাহিক রোগী দেখার চেম্বার। বেশ সুন্দর চেম্বার। সপ্তাহের একদিন প্রচুর রোগী আসেন তার চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। যাইহোক এখানে তাঁর চেম্বার দেখে পাশেই ফুফাতো ভাই তাহেরের বাড়ীতে গিয়ে নাস্তা করলাম।

পাশেই বড়াল নদী। এখান থেকেই শুরু হবে নৌকায় যাত্রা। সকাল দশটায় নদীর পাড়ে এলাম। ডাঃ এনামুল করিমের ভাতিজা বাচ্চুর নেতৃত্বে নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নৌকার সাজসজ্জা আর আয়োজন দেখলে যে কেউ বলবে – এটা জমিদারদের নৌবিহার। ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকায় প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। চেয়ার টেবিল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। রান্না বান্নার সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। চা নাস্তার ব্যবস্থা আছে। এমন দারুন আয়োজনে সবাই মুগ্ধ ।

এরপর ঠিক সোয়া ১০ টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। বড়াল নদী ধরে সোজা উত্তর দিকে। ভাঙ্গুড়া, বড়ালব্রীজ হয়ে আমরা যাবো খান মরিচ ইউনিয়নের সাতবাড়ীয়া গ্রামে। দারুন এবং অসাধারন এই নৌভ্রমন। সত্যি কথা হলো এই লম্বা জীবনে এমন আনন্দময় নৌকা ভ্রমন আর কখনও হয়নি। নৌকায় যাত্রা শুরুর পর থেকেই ঢাকা ও রাজশাহী থেকে আগত সঙ্গীদের সাথে কথা হচ্ছে। কে কোথায় তা ছবি দিয়ে ফেসবুকে আপডেট করা হচ্ছে। মেসেঞ্জারে চ্যাট আর মোবাইলে কথা বিনিময় চলছে। একঘন্টার কমসময়ের মধ্য আমাদের নৌকা এসে ভিড়লো বড়ালব্রীজ ঘাটে। রাজশাহী থেকে ট্রেনযোগে ডাঃ নাজমুল আলম গামু এখানে এসে অপেক্ষা করছিল। তাঁকে নৌকায় তোলা হলো। এরপর নৌকা বড়াল – গুমনি নদী ভেদ করে ছুটে চললো সোজা উত্তরদিকে। ভাঙ্গুড়া বড়ালব্রীজ পিছনে ফেলে হান্ডিয়াল, নিমাইচড়া ব্রীজ।

ঘড়ির কাটা যখন ঠিক একটা – তখন পৌছালাম নিমাইচড়া ব্রীজে। এখানেই মিলিত হলাম ঢাকা থেকে আগত ডাঃ শেখ আলীমুজ্জামান এবং ডাঃ রওশন আনোয়ারের সাথে। উনাদের নৌকায় তুলে বিলদর্শন করতে করতে আমাদের গন্তব্য খানমরিচ ইউনিয়নের সাতবাড়ীয়া গ্রামে। ঐ গ্রামের নুরুল আমিন ভাইয়ের বাড়ীতে যাত্রা বিরতি । চারিদিকে বিল মাঝে নুরুল আমিন ভাইয়ের পাকা দ্বিতল বাড়ী। রাজশাহী আর্ট কলেজে পড়া নুরুল আমিন ভাই গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি। রাজনীতি এবং সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত। তাঁর বাড়ীতেই আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। আমাদের পুর্বপরিচিত বন্ধু নুরুল আমিন ভাই আমাদের জন্যে যে আয়োজন আর ভোজনের ব্যবস্থা করেছে তা মনে থাকার মত। আদি বাঙালী খাবার। চলনবিলের দেশী মাছের অর্ধ ডজন আইটেম। ছোট মাছ, টাকি ভর্তা, পুটি ভাজা, টেংড়া মাছ, বোয়াল মাছ, রুইমাছ সহ শাক সবজি দেখে আমাদের সকলেরই পেট এবং মন দুটোই ভরে গেল।

এখানে ভোজনের সাথে যোজন হলো –এক অসাধারন ঘটনা। মিস কারিনা নামে একজনের উপস্থিতি । সে পূরুষ থেকে নারীতে রুপান্তিত। আগে নাম ছিল আবু হানিফ। নুরুল আমিন ভাইদের প্রতিবেশী। ত্রিশ বছরের এই যুবক দশ বছর বয়সী এক সন্তানের জনক। সেই আবু হানিফ দুই বছর পুর্বে মেয়েতে রুপান্তরিত হয়ে মিস্ কারিনা হয়েছে। তার শারিরিক কিছু সমস্যা দেখা দিলে ভারতের ভেলোরে চিকিৎসা করা হয় এবং অপারেশন করে তাকে মেয়ে বানিয়ে দেয়। সেই মিস কারিনাকে নিয়ে আমাদের সাথে থাকা চারজন চিকিৎসক আর আমাদের সবার যেন কৌতুহল শেষ হচ্ছিল না। এছাড়া ঐ সময়টুকু খানমরিচ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলী ভাইয়ের সঙ্গদান ভাল লেগেছে।

ভোজনের পর কিছুটা শয্যাশয়ন করে সাতবাড়ীয়া ঘাট থেকে বিদায় নিলাম কিন্তু সাথে আনলাম নুরুল আমিন ভাইকে। দর্শন যে আরো বাঁকী রয়েছে । আমার অতি আগ্রহে সিদ্ধান্ত হলো সমাজ গ্রাম পরিদর্শনের।এখানে আছে মোঘল স্থাপত্যে নির্মিত ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ, কামেলে পীর হযরত আশরাফ জিন্দানী ( রঃ) মাজার, ঐতিহাসিক দীঘি, শিতলাই জমিদার বাড়ী, ঐতিহ্য
মন্ডিত সমাজী পরিবারের বাসস্থান।

এরপর ভাঙ্গুড়া উপজেলার সাতবাড়িয়া থেকে চাটমোহর উপজেলার সমাজ গ্রামে এসে পৌছালাম। ঐতিহাসিক মসজিদ, মাজার, দীঘি দেখলাম। অনেক ছবি ধারন করা হলো। সময় স্বল্পতার কারনে বেশী সময় থাকা সম্ভব হলো না। ইচ্ছে থাকার পরও শিতলাই জমিদার বাড়ী দেখা হলোনা। এরপর সমাজ বাজারে এসে চা খেলাম। বাজারটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।

ইতিমধ্যে সুর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে — বিলভ্রমন সমাপ্ত হয়ে আসছে। সমাজ বাজার থেকে আবার বিলে যাত্রা করলো। আমাদের নৌকা নিমাইচড়া ব্রীজের পশ্চিমে বিলের মাঝে এসে নোঙ্গর করলো। এখানে বসেই সুর্যাস্ত দেখে সন্ধ্যার পর বিল থেকে উঠে পড়লাম। পাশেই নিমাইচড়া ব্রীজের পাশে ঢাকা থেকে আসা গাড়ী এবং পাবনা থেকে যাওয়া মাইক্রোবাস অপেক্ষায় ছিল। এরপর সবাইকে বিদায়ের পালা। নৌকা বিদায় করে সেখানে অপেক্ষমান মাইক্রোবাসে আমরা উঠলাম আর ঢাকা থেকে আগতরা তাঁদের গাড়ীতে উঠে দুই গাড়ী একসাথে রওয়ানা দিয়ে বনপাড়া – হাটিকুমরুল মহাসড়কে উঠলাম। তারপর মান্নান নগর উঠে দুইদিকে যাত্রা। আমরা কাছিকাটা থেকে চাটমোহর হয়ে পাবনা পৌছালাম রাত সোয়া নয়টায়। নিরাপদে শেষ হলো সোয়া চৌদ্দ ঘন্টার আনন্দময় চলনবিল ভ্রমন। চলনবিল ভ্রমন ১৪ ঘন্টায় শেষ হলেও শেষ হবেনা এই ভ্রমনের সুখস্মৃতি –। 
সমাপ্ত। 

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা 
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।