করোনা কালের জীবন ধারা–০৯

— এবাদত আলী —

মহামারি করোনাভাইরাস বিশে^র বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশে হামলা করার পর থেকেই কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হলে বাধ্যতামুলক মাস্ক ব্যবহার এসব মেনে চলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথা সরকার থেকে বার বার ঘোষণা আসে। কিন্তু সামজিক দুরত্ব বা শারিরিক দুরত্ব বজায় রাখার বেলায় অন্যরা আংশিক মেনে চল্লেও মুসুল্লিদের জন্য এসব দারুন সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। কারণ মসজিদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে জামায়াত করতে হবে। আর নামাজের জামায়াত মানেই একজনের পাশে আরেকজন কাতারবন্দি হয়ে গায়ের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো।
এমনিতো অনেক মুফতি- মওলানা সাহেব করোনা বলে কিছু নেই, এটা আল্লাহর একটি গজব। আসমানী বালা। কিয়ামতের আলামত। কেউ বলেন এটা ঈমানী পরীক্ষা। জনৈক মুফতি সাহেবতো জোর দিয়েই বলেছেন করোনা আমাদের দেশে আসবেনা। আসলে কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে। কারো কারো সাথে (করুনা!) করোনা ভাইরাসের কথা-বার্তা ও হয়েছে। তাঁর সপ্নের তাবির অর্থাৎ তার ফরমুলা নিয়ে সারা আমেরিকা নাকি তোলপাড় বলে তিনি জোর গলায় বলেছেন। সে যাইহোক দেশের এই বিপদ সংকুল মহামারি উত্তরণের জন্য সঙ্গনিরোধ, লকডাউন পালন করতে হলে মসজিদের নামাজের জামায়াত আপতত বন্ধ রাখতে হবে।
রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে কেরোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগ এ আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি বা হাঁচি দেবার ফলে বাতাসে নিক্ষিপ্ত বহু লক্ষ অভিক্ষুদ্র শ্লেষ্মাকণা বাতাসে ভাসতে শুরু করলে নিকটবর্তী অপর কোন ব্যক্তি সেই ভাইরাসযুক্ত বাতাস শ^াস-প্রশ^াসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে তার দেহে ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে। সাধারণ শ^াস-প্রশ^াসের কারণেও খুবই স্বল্প পরিমাণ ভাইরাসকণা বাতাসে ভাসতে পারে। এছাড়া ভাইরাসকণা টেবিলে বা অন্য কোন পৃষ্ঠে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কিংবা ভাইরাসযুক্ত হাত দিয়ে স্পর্শের মাধ্যমে পৃষ্ঠের উপাদান ভেদে কয়েক ঘন্টা বা কয়েকদিন লেগে থাকতে পারে, যেই পৃষ্ঠে আরেকজন ব্যক্তি স্পর্শ করে তারপরে নাকে মুখে বা চোখে হাত দিলে ঐ ব্যক্তির শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির মধ্য দিয়ে ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পারে।
ইসলাম ধর্মীয় বিধান মতে জামাতে নামাজ আদায় করতে যে কাতার করা হয়, তার মাঝে যেন কোন ফাঁক না থাকে। নিজ নিজ পায়ের বৃধ্যাঙ্গুলির দিকে তাকিয়ে কাতার সোজা করে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর নিয়ম। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে নামাজ মাকরুহ হবে। এক্ষেত্রে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার বিপরিত অবস্থান বলতে হয়।
তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশে মসজিদে নামাজ আদায়ের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। গত ৬ এপ্রিলে’২০২০ জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় আজ থেকে মসজিদে কোন জামায়াতে ৫ জনের বেশি মুসুল্লি অংশ নিতে পারবেননা। আর শুক্রবার জুম‘ার নামাজের জামায়াতে অংশ নিতে পারবেন সর্বোচ্চ ১০ জন। একই সাথে মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডাসহ অন্যান্য ধর্মের উপসনালয়গুলোতেও ধর্মীয় জমায়েতের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মসজিদে ওয়াক্তিয়া নামাজে যে ৫জন জামায়াত করবেন তাও একে অপর থেকে ১মিটার বা ৩ ফুট দুরত্বে দাঁড়াতে হবে। গা ঘেঁষে দাঁড়ানো যাবেনা। উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে এসময়ে সারাদেশের কোথাও ওয়াজ মাহফিল, তাফসির মাহফিল,তাবলীগের কার্যক্রম, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
এতে অনেক ইমাম এবং মুসুল্লি তেলে বেগুনে জ¦লে ওঠেন। তারা এটা কিছুতেই মানতে নারাজ। তাদের ধারণা মসজিদে জামায়াত ছাড়া বাড়িতে নামাজ আদায় করলে নামাজ হয়না। দু একজন মুফতিও তার সাথে সুর মিলিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তাদের ধারণা ও ধর্মীয় জ্ঞান-গরিমা সীমিত। কারণ জীবন রক্ষাসহ অনেক ক্ষেত্রেই তা শিথিল করার বিধান আছে।
মসজিদে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে ইসলামের দিক নির্দেশনা হলো- মসজিদ থেকে আজানের শব্দ শোনা যায়, এমন সব বাড়ির লোকেরা মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়বে। এ ব্যাপারে জোর তাগিদ রয়েছে। কেউ কেউ জামায়াতে উপস্থিত হওয়াকে সুন্নতে মুয়াক্কাদা বলেছেন এবং জামায়াতে শামিল না হওয়াকে মাকরূহে তাহরিমি বলেছেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি কিংবা মারাত্মক অসুস্থতা থাকলে মসজিদে না গিয়ে বাড়িতেও নামাজ আদায় করা যাবে।
করোনাভাইরাসের আক্রমণের প্রথম দিকে দেশ বিদেশের প্রায় সকল মসজিদেই এই গজব থেকে রক্ষা পাবার জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। এরপর কোরানাভাইরাসের আক্রমণ বৃদ্ধি পাবার কারণে গত ১৩ মার্চ মালয়েশিয়ার পার্লিসে জুম‘ার নামাজ স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
গত ২৮ মার্চ’ ২০২০ সৌদি গেজেটে বলা হয় ‘বিশ^ব্যাপি করোনভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করায় মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদীনার মসজিদে নববী ছাড়া দেশের সব মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রিয়াদে কাউন্সিলের ২৫তম বিশেষ জরুরি অধিবেশনে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মসজিদগুলোতে নামাজ বন্ধ থাকলেও আগের মত নিয়মিত আজান হবে। সৌদি আরবের জ্যেষ্ঠ আলেমদের কাউন্সিলের বরাত দিয়ে সৌদি গেজেট জানায়, যে কোন বড় বিপর্যয়ের সম্ভাব্য ক্ষতি কমাতে ইসলামী শরীীয়াহ অনুযায়ী মসজিদে জুম‘াসহ সব ধরণের জামাত বন্ধ রাখার সুযোগ আছে। যেহেতু করোনাভাইরাসে বড়ধরণের ঝুকি রয়েছে তাই জ্যেষ্ঠ আলেমদের কাউন্সিল আপতত জামায়াতে নামজ আদায় বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। করোনভাইরাস থেকে শতর্কতার জন্য গত ২৭ ফেব্রুয়ারি-২০২০, হতে হজ ও ওমরাহের ভিসা স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি পবিত্র ক‘াবা প্রাঙ্গনে তাওয়াফ ও স্থগিত করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের আক্রমণের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের ৫০ হাজার ৩শ ৯৯ টি মসজিদ, ভারতের প্রায় ৩ লাখ এবং সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ২৫ লাখ মসজিদেই নামাজ আদায়ের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৫ শ টি গীর্জা রয়েছে এবং ৪০ হাজার ৪ শ ৩৮ টি মন্দির রয়েছে, সেখানেও তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। (সময়কাল ০৫-০৫-২০২০) (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
তাং ১৫/০৫/২০২৪