// সঞ্জু রায়, বগুড়া:
হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বগুড়া শেরপুরের ভবানীপুর সতীপীঠ। সারাবিশ্বে থাকা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ৫১ টি শক্তিপীঠের অন্যতম এই মন্দির ঘিরে ধর্মীয় আবেগের জায়গা রয়েছে সকলের। উৎসব ছাড়াও সারাবছর বিভিন্ন দেশের দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে এই মন্দিরে। কিন্তু ইদানিংকালে মন্দিরের কাছে থাকা একটি দেশীয় মদের দোকানে সৃষ্টি হওয়া নেতিবাচক পরিবেশে পবিত্রতা নষ্টের উপক্রম হয়েছে এই শক্তিপীঠের যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সনাতন ধর্মের পুঁথি অনুযায়ী সারাবিশ্বে থাকা দেবী সতীর ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম বগুড়া শেরপুরের মা ভবানী মন্দির। কবে কখন এই মন্দিরের স্থাপনা হয়েছিলো তার সঠিক কোন সময় জানা না গেলেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে করতোয়া তটের এই পূণ্যস্থানের কথা তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ১.৬২ একরের উপর মূল মন্দিরের অবকাঠামো নির্মাণ করেছিলো নাটোরের রানী ভবানী যার নির্মাণশৈলী ও কারুকার্য মন্ডিত মন্দিরের সৌন্দর্য্য আজো মুগ্ধ করে সকলকে।
ঐতিহাসিক এই মন্দিরের পুরোহিত রথিন্দ্রনাথ ভাদুড়ি বলেন, উৎসব ছাড়াও এই মন্দিরে দেশ-বিদেশ থেকে সারাবছর আগমন ঘটে হাজারো দর্শনার্থীর। ভারত ছাড়াও রাশিয়া, নেপাল, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা থেকে প্রতিনিয়ত মায়ের সান্নিধ্য দর্শনার্থী আসেন এখানে। কেউবা মায়ের দর্শনে, কেউবা মায়ের শাখারি পুকুরে পূণ্যস্নান আবার কেউবা আসেন মনের নানা বাসনা পূরণের আশায়। কথিত আছে মায়ের মন্দিরে এসে আজ অবধি খালি হাতে ফেরেনি কোন প্রকৃত ভক্ত। তবে দূর দূরান্ত থেকে মন্দিরে আসা দর্শনার্থী ও মন্দির কমিটির সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ইদানিং কালে মন্দিরের পবিত্রতা নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সতীপীঠের পাশে থাকা একটি দেশীয় মদের দোকান, যেখানে সৃষ্ট নেতিবাচক পরিবেশ প্রভাব ফেলছে এই পূণ্যস্থানে যা অতিদ্রুত একটি সুষ্ঠু সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
দিনাজপুর থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে মন্দিরে মায়ের দর্শনে আসা বেসরকারি চাকুরিজীবি পিযূষ চক্রবর্ত্তী বলেন, এই মন্দিরের সাথে সারাবিশ্বের সনাতন ধর্মের মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। মন্দিরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু মন্দিরের সন্নিকটেই দীর্ঘ বছর ধরে থাকা এই দেশী মদের দোকান আমাদের দেশের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে সত্যি বেমানান। যেভাবে অবাধে সবাই এই দোকান থেকে মদ কিনে খেয়ে মদ্যপ অবস্থাতেই মন্দিরে প্রবেশ করছে যে দৃশ্য মাতৃভক্ত হিসেবে তাদের হৃদয়ে সত্যিই রক্তক্ষরণ করছে। দ্রুততম সময়ে এই দোকান অন্যত্র সরানোর দাবি জানান তিনি। শুধু পিযূষ নয় তার মতো এই দাবি জানান মন্দিরে মায়ের দর্শনে আসা শত শত ভক্তবৃন্দ।
এ প্রসঙ্গে মা ভবানি মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক অপূর্ব চক্রবর্ত্তী বলেন, দেশীয় মদের দোকানটি দীর্ঘ বছর থাকলেও ইদানিংকালে এই দোকানের কারণে যে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা সত্যিই আর মানা যাচ্ছেনা। বারংবার তাদের সভায় এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে মৌখিকভাবে দোকানটির সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হলেও তারা কোনভাবেই কর্ণপাত করেনা। মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষায় এই দোকানের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান।
এদিকে মন্দিরের পাশে থাকা এই দেশী মদের দোকানে টানা কয়েকদিনের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, লাইসেন্সের কোন শর্তাবলীরই তোয়াক্কা না করার অভিযোগ রয়েছে পৈত্রিকসূত্রে মদের দোকানটির মালিক রতন সরকার এর বিরুদ্ধে। শিশু থেকে শুরু করে পারমিটবিহীন যে কারো কাছেই হরহামেশা বিক্রি করা হচ্ছে মদ যারা মাতাল অবস্থাতেই প্রবেশ করছে পাশে থাকা পবিত্র শক্তিপীঠ মন্দিরে। জানা যায়, একই দোকানের মালিকের সাথে রয়েছে মন্দিরের জায়গা সংক্রান্ত বিবাদও যা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন দোকানটির সংশ্লিষ্টরা। দোকানে গেলে মূল মালিক রতন সরকারকে পাওয়া না গেলেও দোকানে থাকা তার সম্পর্কে ভাতিজা এক সেলসম্যান বলেন, তারা নিয়ম মেনেই দোকান পরিচালনা করছেন তবে মন্দিরের পাশে দোকান হলেও তাদের দৃষ্টিতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। তবে লাইসেন্সে কি কি শর্ত আছে এ বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলে জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এছাড়াও রতন সরকারের সাথে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করলে জানান তিনি বাইরে আছেন।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই মন্দিরে অনেকবার গেলেও মন্দিরের পাশে এই দেশীয় মদের দোকানের বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না। মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষায় দ্রুততম সময়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, নথি অনুযায়ী বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ মিলিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই মন্দিরের সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ২৬২ একর যার অধিকাংশই নাটোরের রানী ভবানীর দানকৃত।