শিলাইদহে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ


–এবাদত আলী —
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার হিসাবে শিলাইদহে আগমণ করেন ১৮৯১ সালে। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে তিনি শিলাইদহে আসেন।
কুষ্টিয়া জেলা সদর থেকে ১০ কিঃ মিঃ উত্তর-পুর্বে এক কালের খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা নদীর দক্ষিন তীর ঘেঁষে শিলইদহ কুঠিবাড়ি অবস্থিত।
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন অগাধ সম্পত্তির মালিক। কিন্তু বিলেতে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে দেখা যায় যে, তিনি ব্যবসায় ক্ষেত্রে বহু দায়-দেনা রেখে গেছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখন বিষয় সম্পত্তি এমন কি বাড়ির আসবাব পত্র বিক্রি করে সে সকল দায় দেনা পরিশোধ করেন।
এর পর তিনি উড়িষ্যার তিনটি জমিদারী, পাবনার শাহজাদপুর (বর্তমানে সিরাজ গঞ্জ জেলায় অবস্থিত।) রাজশাহীর (নওগাঁ) কলিগ্রাম ও নদীয়া বর্তমান কুষ্টিয়ার বিরাহিমপুর জমিদারী খরিদ করে তার মালিক সাব্যস্ত হন। নাটোরের রাণীভবানীর এষ্টেট হিসাবে খ্যাত উত্তরইব্রাহীম পুর পরগনা (বিরাহীমপুর)১৮০০ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিলামে খরিদ করেন। পরবর্তীকালে শেলী নামক এক নীলকর সাহেবের নিকট হতে ১৮৩৩ সালে শিলাইদহ কুঠি ক্রয় করেন এবং ঠাকুর জমিদারেরা উক্ত কুঠিকে বাসভবন হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। সে মতে কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর জমিদারী দেখা শোনার জন্য স্ত্রী মৃণালীনি দেবী, পুত্র রথীন্দ্রনাথ,শমী, কন্যা রাণী ও মীরা সহ আরেক সন্তান নিয়ে রীতিমত সংসার পাতলেন শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ভাবনা ও অন্যান্য সাহিত্য কর্ম সৃষ্টিতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠি বাড়ির রয়েছে বিশেষ অবদান ও পটভুমিকা। ঠাকুর পরিবারের জমিদারী পরিচালনার জন্য এখানে এসে তিনি ভালোবেসেছিলেন ছায়ঘেরা নিভৃক পল্লী শিলাইদহকে। এছাড়া আকৃষ্ট হয়েছিলেন এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য এবং প্রমত্তা পদ্মা নদী ও পদ্মার বুক থেকে বেরিয়ে আসা গড়াই নদীর প্রতি। শিলাইদহ কুঠি বাড়ি কবির সাহিত্য কীর্তি ও নানা রচনার সঙ্গী।
শিলাইদহের নামকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন, “এই গ্রামে নদী তীরে শেলী নামক অত্যাচারি নীলকরের কুঠি ছিল। শেলীর দহ (অতল স্পর্শ ঘুর্ণিময় অংশ) অর্থে শিলাইদহ নাম হয়েছে। শিলাইদহের ভদ্র পল্ল¬ী রবীন্দ্রনাথের আমলে ব্রাহ্মন, কায়স্থ, কুমার, কামার,জেলে, তাঁতি, সুত্রধর, প্রভৃতি জাতির দ্বারা পুর্ণ ছিল। উক্ত গ্রামে হাট বাজার,মাইনর স্কুল,গার্লস স্কুল,ডাক্তারখানা, কবিরাজ বাড়ি, গ্রামের শোভা বর্ধন করতো। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি প্রাঙ্গনে ছিলো ডাকঘর। গ্রামের বিশিষ্ট প্রসিদ্ধ আকর্ষন ছিলো গোপীনাথ দেবের মন্দির ও খোরশেদ ফকিরের দরগা।
শিলাইদহ ছিলো রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় স্থান। শিলাইদহে বসে তিনি অনেক সাহিত্য কর্ম রচনা করেছেন। সে কালে শিলাইদহ তাঁর লেখায় জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তাঁর কবিতা গল্পে স্থান করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ যুগে তাঁর কাছে দেশ ও জাতি পেয়েছে অপরিমেয় দান। সোনার তরী, চৈতালী, চিত্রা, কথা ও কাহিনী, কল্পণা, ক্ষণিকা,গীতিমাল্য, বলাকা, চিত্রাঙ্গদা, গীতাঞ্জলী, চিরকুমার সভা,গল্পগুচ্ছ, পঞ্চভূতের ডায়েরী, জীবন স্মৃতি সহ অসংখ্য রচনা যা পরবর্তীকালে অন্য বইতেও সংযোজিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের “ দুই বিঘা জমি”র পটভূমি শিলাইদহ গ্রাম। এই কবিতার চরিত্র ঘটনা সমস্তই এই গ্রামের Ÿাস্তব চিত্র। দুই বিঘা জমি কবিতার দুটি পংতি যেমনঃ
“রাখি হাটখোলা
নন্দীর গোলা
মন্দির করি পাছে…….
আমার বাড়ীর কাছে।”
এই হাটখোলা ,নন্দীর গোলা আর মন্দির সেকালের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হলে যে কোন পথিককেই কয়েকটি স্থান পার হতে হতো। বর্তমানে এগুলো সব পদ্মার করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে।
কবি রবীন্দ্রনাথের সময় গড়াই নদীতে পলি পড়ার কারণে নৌকা বা ষ্টিমারে যাতায়াত অসুবিধা হওয়ায় তিনি কুষ্টিয়ার গড়াই্ নদীর পাড় হতে শিলাইদহ পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে রাস্তার নাম “রবীন্দ্র সড়ক।” রবীন্দ্রনাথ বহু অর্থ ব্যয়ে শিলাইদহে “মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়” নামে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। গ্রামে পুর্বে যে যাত্রা দল ছিলো তা থেকে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে নাটকের দল গঠিত হয়েছিলো।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘদিন একটানা শিলাইদহে স্ত্রী, পুত্র পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। ১৯০১ সালে বড় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে স্বপরিবারে তিনি কলকাতা গমণ করেন। পরে তিনি শিলাইদহের বাড়িতে ফিরে এলেও তাঁর স্ত্রী মৃণালীনি দেবী আর ফিরে আসেননি। ১৯০২ সালের অগ্রহায়ণ মাসে তার দেহান্তর ঘটে।
এর পর থেকে নির্জন কুঠিবাড়িতে কবি প্রায় একাকীই সময় কাটাতেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি আত্মবিনোদনের ইচ্ছায় গীতাঞ্জলীর গান গুলো ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এর পর শিলাইদহের জমিদারীর ম্যানেজার হিসাবে তাঁর ভাইয়ের জামাতা বিশিষ্ট সাহিত্যিক “সবুজ পত্র সম্পাদক” প্রমথ চৌধুরীর (বিরবল ) ওপর ন্যাস্ত করেন। ১৯২২ সালে ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ভাগাভাগি হয়। শিলাইদহ এষ্টেট তাঁর ভাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগে পড়ে। রবীন্দ্র পত্র গুচ্ছে শিলাইদহের স্মৃতির কথা তিনি লিখেছেন, “আমার যৌবন ও পৌঢ় বয়সের সাহিত্য রস সাধনার তীর্থ স্থান ছিলো পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ পল¬ীতে।” (রবীন্দ্রনাথ ১০ চৈত্র ১৩৪৬)।
১৯২৩ সালে জমিদার রবীন্দ্রনাথ শেষ বারের মত শিলাইদহ সফর করেন। বহু প্রজা এসেছিলেন জমিদার বাবু রবীন্দ্র নাথকে দেখতে ও নজরানা দিতে।
এলাকার মুসলমান মেয়েরা কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরকে একটি নকশী কাঁথা উপহার দিয়েছিলেন।

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

প্রেরক: এবাদত আলী
সদস্য, পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ০৭/০৫/২০২৪.